সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ভাষা আন্দোলনের ৬০বছরে স্বীকৃতি পাননি গোপালগঞ্জের আবুল হোসেন ভুঁইয়া, অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না তার পরিবার


বাদল সাহা, গোপালগঞ্জ থেকে :: ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছরেরও ভাষা সৈনিক হিসাবে স্বীকৃতি পাননি গোপালগঞ্জের ভাষা সৈনিক আবুল হোসেন ভূইয়া। এমনকি নানা রোগে আক্রান্ত হলে অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না তার পরিবার। দীর্ঘ ৬০ বছরের কেউ তার খোঁজ খবর না নেওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন তার পরিবারের সদস্যরা। ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর এবং স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পার হলেও মৃত্যুর আগে ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি পাবেন এমনটাই আশা আবুল হোসেন ও তার পরিবারে সদস্যদের।

তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমায় ১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন আবুল হোসেন ভুঁইয়া। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে আবুল হোসেন সবার ছোট। ১৯৬৫ সালে কায়েদে আজম কলেজের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর হিসেবে তার চাকুরী জীবন শুরু হয়। সাতচল্লিশ সালে দেশ বিভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীরা যখন বাঙ্গালীদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরন করতে থাকেন সেই বায়ান্ন সালে আবুল হোসেন গোপালগঞ্জের তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ১৯৫২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকায় ঘোষনা দিলেন উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্টভাষা। এর প্রতিবাদে ২১ ফেব্র“য়ারী ভাষা আন্দোলনে “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই” এই স্লোগান দিতে দিতে ঢাকায় পুলিশের বুলেটে রফিক-সালাম-বরকতেরা যখন শহীদ হলেন তখন গোপালগঞ্জের আবুল হোসেন মেনে নিতে পারেননি বাঙ্গালীদের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া উর্দূ ভাষাকে। এঘটনা যখন ঢাকার সীমানা পেরিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন পাকিস্তানী শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে গোপালগঞ্জের পথ-প্রান্তর মিছিলে প্রকম্পিত করে তুলেছিলেন আবুল হোসেন ভ্ুঁইয়া। এমনকি সমমনা ছাত্রদেরকে নিয়ে গঠন করলেন ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’। শহরের দেয়ালে দেয়ালে চিকা মেরে ও মিছিল মিটিং এর মাধ্যমে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন “ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”।

বায়ান্নো সালের ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন আবুল হোসেন ভুঁইয়া। অস্ত্র হাতে শক্রর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে অসামান্য ভূমিকা রাখেন তিনি। স্বাধীনতার পর তিনি “গোপালগঞ্জের ইতিকথা” নামের একটি বই রেখেন। দেশ ও মাতৃভাষার প্রতি আপোষহীন এই লড়াকু সৈনিক আজ সাতানব্বই বছর বয়সের এক বৃদ্ধ। ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর এবং স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পার হলেও কোন স্বীকৃতি মেলেনি চিরসংগ্রামী এই মানুষটির।

তারা বাড়ীতে গেলে সাংবাদিকদের কাছে পেয়ে তিনি মনে করতে থাকনে ভাষা আন্দোলনের কথা। কিন্তু অসুস্থ আর স্মৃতিভ্রষ্ট থাকায় পুরো কথা তিনি মনে করতে পারেনি। যেটুকু বলেছে তাও বোঝার উপায় নেই। বিগত তিন-চার বছর অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন প্রায় আবুল হোসেন। ঠিকভাবে চলাফেরা করেত পারেন না তিনি। ফলে সারাদিন তিনি বিছানায় শুয়ে বসে সময় কাটান। অর্থের কারনে ঠিক ভাবেও চিকিৎসা করতে পারছে না তার পরিবার। চতুর্থ শ্রেণীর ছোট্ট নাতি খবরের কাগজের নানান খবর পড়ে শোনায় বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত আবুল হোসেনকে।

আবুল হোসেন ভুঁইয়ার স্ত্রী শামীমা হোসেন মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার স্বামীর ভুমিকায় গর্বিত হলেও আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছরেরও তার স্বামীকে যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। এ অক্ষেপ করে আবুর হোসেন মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠেন। তখন তাকে আমার বুঝাতে হয়। এতদিন যখন কেউ খোঁজ নেয়নি তখন কেঁদে আরা কি হবে। তিনি এক বুক আশা নিয়ে বলেন, আমার স্বামী যেন মৃত্যুর আগে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু পায়।

ভাষা সংগ্রামী আবুল হোসেন ভুঁইয়ার দুর্দশা দেখে চতুর্থ শ্রেণীর ছোট্ট শিশুটি নাসিমা হাসনাত মৌমির কোমল মনটিকেও নাড়া দিয়েছে। সে জানায়, তার দাদাকে নিয়ে সে গর্বিত। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তার দাদা ঠিক ভাবে হাটা চলা করতে পারে না। সব সময় বিছানায় শুয়ে কাটাতে হয়। প্রতিদিনই তাকে পত্রিকার খবর পরে শুনাতে হয়। তার পরেও তার কোন কষ্ট নেই বলে জানায় মৌমি।

এলাকাবাসী জানায়, মাতৃভাষা আর দেশের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে আবুল হোসেন। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানীরা তাকে ধরে নিয়ে গেলেও কোন রকমে পালিয়ে এসেছিলেন তিনি। এসেই আবার যুদ্ধ করেন। তবে তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। দীর্ঘ সময়েও এ ভাষা সংগ্রামীকে যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে এলাকাবাসী।

কবি, সাংবাদিক ও গবেষক রবীন্দ্রনাথ অধিকারী জানান, ৫২ সালের ২১ফেব্র“য়ারী ঢাকায় পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার নিহত হলে ভাষা সৈনিক আবুল হোসেন নেতৃত্বে বাংলা ভাষার দাবীতে গোপালগঞ্জে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। তাদের নেতৃত্বেই ৫৪ সালে গোপালগঞ্জ শহরের ব্যাংক পাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাসার সামনে জেলায় প্রথম শহীদ মিনার নির্মান করা হয়। এই শহীদ মিনারের ফুল দিয়ে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। কিন্তু এ সংগ্রামী মানুষটি এখন জীবন সংগ্রামের শেষ প্রান্তে এসেও লড়াই করছেন। ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছরেও এ সংগ্রামী মানুষটি খবর রাখেনি কেউ। পরবর্তী সময়ে শহরের পৌর পার্কে স্থায়ী ভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মান করা হয়। সেখানেই ফুল দিয়ে শহীদের শ্রদ্ধা জানায় গোপালগঞ্জবাসী। 
Ruby