বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ইন্টারনেটে বাংলা লেখার পদ্ধতি


নুরুন্নবী চৌধুরী:: কম্পিউটারে প্রযুক্তি যত এগিয়েছে, বেড়েছে এর সহজ ব্যবহার। সারা বিশ্বের প্রযুক্তিপ্রেমীরা আগ্রহী থাকেন নিজের ভাষায় প্রযুক্তি ব্যবহার করতে। আর ইন্টারনেটে নিজের ভাষা লেখা বা নিজের ভাষায় কোনো কিছু প্রকাশের সুবিধা তৈরির ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন অনেকেই।তাঁরা তৈরি করেন ছোট ছোট কিছু প্রোগ্রাম, যা টুলস নামে পরিচিত। ইন্টারনেটে এখন বাংলা লেখার জন্য রয়েছে দারুণ কিছু প্রোগ্রাম।
কম্পিটারে বাংলা লেখার জন্য আগে বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করা হতো।সমস্যা ছিল এক কম্পিউটারে বাংলা লিখে অন্য কোনো কম্পিউটারে নিয়ে গেলে তা দেখা যেত না; যদি না কম্পিউটারে ওই নির্দিষ্ট সফটওয়্যারটি ইনস্টল করা থাকত। আন্তর্জাতিক সংকেতায়ন ব্যবস্থা ইউনিকোড ৩.০-এ বাংলা ভাষা যুক্ত করার পর ইউনিকোড সমর্থন করে এমন সব অপারেটিং সিস্টেম এবং সব সফটওয়্যারেই এখন বাংলা দেখা ও লেখা সহজ। এ সুবিধাটি কাজে লাগিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক ইউনিকোডভিত্তিক প্রোগ্রাম, যা দিয়েইন্টারেনেটে সহজেই বাংলা লেখা ও পড়া যায়।

বাংলা টুলস
ইন্টারনেটে বাংলা লেখার সফটওয়্যার অভ্র। ওমিক্রন ল্যাবের তৈরি এই মুক্ত সফটওয়্যারের মাধ্যমে ইন্টারনেটে বাংলা লেখা যায় নানা কি-বোর্ড লে-আউট ব্যবহার করে। ইউনিকোড সমর্থিত অভ্র কি-বোর্ডে রয়েছে অভ্র ফোনেটিক, অভ্র ইজি, বর্ণনা, ন্যাশনাল (জাতীয়) ও মুনির, প্রভাত কি-বোর্ড লে-আউট। এর মধ্যে যেকোনো একটি ব্যবহার করে বাংলা লেখা যায়। রয়েছে এর বহনযোগ্য সংস্করণ (পোর্টেবল অ্যাডিশন)। এ ছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের পছন্দের লে-আউটও বানানোর সুবিধা আছে অভ্রতে। কি-বোর্ডে F12 বা নির্দিষ্ট নির্বাচিত কি-বোর্ড লে-আউট চেপে কি-বোর্ড বাংলা বা ইংরেজি করে নেওয়া যায়। অভ্রতে আছে নতুন বানান পরীক্ষক। এতে যুক্ত হয়েছে এএনএসআই টাইপিং সুবিধা। ফলে অ্যাডোব ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটরসহ বিভিন্ন সফটওয়্যারে সহজে বাংলা লেখা যাবে। এ ছাড়া নতুন সংস্করণে আছে কনভার্টার টুল। এর মাধ্যমে ইউনিকোডে লেখা ফরম্যাটিং ছাড়াই সাধারণ লেখাকে এএনএসআইতে রূপান্তর করা সম্ভব। যাঁরা কি-বোর্ডে লিখতে চান না তাঁদের জন্য রয়েছে আলাদা লে-আউট, যেখানে মাউস দিয়ে লেখা যাবে। অভ্রের অন্যতম নির্মাতা মেহেদী হাসান খান জানান, সাধারণ ব্যবহাকারীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখেই অভ্রে যুক্ত হচ্ছে নানা সুবিধা। অভ্র বর্তমানে অ্যান্ড্রয়েডসহ বিভিন্ন অপারেটিংসিস্টেমের জন্য তৈরি হচ্ছে।
অভ্র ৫.১.০ পাওয়া যাবে www.omicronlab.com/avro-keyboard.html ঠিকানার ওয়েবসাইটে।

রয়েছে রূপান্তরের সুবিধা
প্রচলিত বাংলা থেকে ইউনিকোড বাংলায় রূপান্তর করার প্রোগ্রামের (কনভার্টার) জনপ্রিয়তাও ইন্টারনেটে বেশ। প্রচলিত বাংলা লেখাকে ইউনিকোডে রূপান্তরের সুবিধা দিচ্ছে bnwebtools.sf.net ওয়েবসাইট।এস এম মাহবুব মুর্শেদ এবং অরূপ কামালের তৈরি এ টুলসটিতে প্রভাত, অভ্র, বর্ণসফট লে-আউটে ইউনিকোডে লেখা যাবে। এ ছাড়া প্রচলিত বাংলায় বৈশাখী, বংশী, বর্ণসফট, ফোনেটিক লে-আউটে লিখেও ইউনিকোডে রূপান্তর করা যাবে। অর্থাৎ ইউনিকোড বক্সে লিখে সাধারণ প্রচলিত বাংলায় যেমন রূপান্তর করা যাবে, তেমনি সাধারণ প্রচলিত বাংলায় লিখে ইউনিকোডেও রূপান্তর করা যাবে। এ ছাড়া ইচ্ছা করলে এ কনভার্টার বক্সে লিখে সেটিকে ইন্টারনেটে ব্যবহার করা যাবে।এ ব্যাপারে এস এম মাহবুব মুর্শেদ জানান, ব্যক্তিগত প্রকল্প হিসেবে বাংলা সংখ্যা থেকে ভয়েসে রূপান্তর করার প্রোগ্রাম এবং একটা উইন্ডোজের জন্য প্রচলিত বাংলা থেকে ইউনিকোড বাংলা কনভার্টার বানানো হয়েছে। সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাজে লাগবে এ ভাবনা থেকেই এটি তৈরি।

আরও কত কি!
বাংলা লেখার ক্ষেত্রটা এখন অনেক বেশি। ব্লগ কিংবা সামাজিক যোগাযোগ সাইটে বাংলা লেখার ক্ষেত্রটি সহজ হয়েছে বিভিন্ন টুলসের মাধ্যমে। এসব টুলসের পাশাপাশি রয়েছে নানা ধরনের ইউনিকোড ফন্টও। ২০০৫ সাল থেকে বিজয় ইউনিকোড ফন্ট চালু আছে। কম্পিউটারে জনপ্রিয় বিজয় সফটওয়্যারের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আনন্দ কম্পিউটার্সের প্রধান নির্বাহী মোস্তাফা জব্বার ফোনেটিক পদ্ধতিতে বাংলা লেখা সম্পর্কে বলেন, রোমান হরফে বাংলা লেখার মাধ্যমে আমরা ঠিক কোথায় পৌঁছতে চাই, তা ঠিক আমার বোধগম্য নয়। ইউনিকোড এবং বাংলা দুটি একই মান নয়; তার পরও বিজয় দুটি মানই সমর্থন করে। এ ছাড়া বিজয়ের অনেক ইউনিকোড ফন্ট রয়েছে।
ব্লগ বা সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে বাংলা লেখা সহজ করে দিচ্ছে বাংলা ডট ওআরজি ডট বিডি (www.bangla.org.bd)। ২০০৬ সালে এই সাইটের বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেন সাজেদ চৌধুরী ও আহমেদ আরিফ সিরাজী। এ সাইটে অভ্র, প্রভাত, ইউনিজয়সহ পাঁচ ধরনের কি-বোর্ড লে-আউটে সরাসরি বাংলা লেখা যায়। লেখাটি কপি করে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পেস্ট করে দিলেই হয়। অনলাইনে সব সুবিধা আছে বলে কম্পিউটারে আলাদা করে সফটওয়্যার ইনস্টল করার প্রয়োজন নেই। রয়েছে বানান পরীক্ষার ব্যবস্থা। আহমেদ আরিফ সিরাজী জানান, এই ওয়েবসাইটটির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলা লেখা সহজ করা, বিশেষ করে করপোরেট ব্যবহারকারী, সাইবার ক্যাফে ব্যবহারকারী এবং নতুনদের জন্য এটি বেশ সহায়ক। যেকোনো অপারেটিং সিস্টেমে যেকোনো ব্রাউজারের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করা যায়। চলতি মাসেই স্মার্টফোনে বাংলা লেখার বিশেষ অ্যাপ্লিকেশন পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।
অনেকেই মোবাইল ফোন থেকে বাংলা লিখতে পারেন না বিল্ট-ইন সুবিধার অভাবে। আর এমন সব সুবিধা নিয়ে রয়েছে সাদা খাতা ফোনেটিক বাংলা কনভার্টার (www.sadakhata.binhoster.com)। এর মাধ্যমে যেকোনো যন্ত্র থেকে বাংলা লেখা যাবে সফটওয়্যার না নামিয়েই। এই সাইটে রয়েছে ফোনেটিক কিম্যাপ লিংক, যার মাধ্যমে রোমান হরফে বাংলা লিখে‘মায়াবী বাংলায় রূপান্তর’ বাটনে চাপলেই নিচের টেক্সটবক্সে ইউনিকোড বাংলায় রূপান্তর হয়ে যাবে। মোবাইল ফোন, পার্সোনাল কম্পিউটার, ম্যাকবুক, আইপ্যাডসহ বিভিন্ন যন্ত্রে এটি ব্যবহার করা যাবে।
রয়েছে বেশ কিছু স্ক্রিপ্ট, যেগুলো বর্তমানে প্রায় বাংলা ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনেই ব্যবহার করে হচ্ছে। ওয়ার্ডপ্রেস বাংলা লেখার জন্য কিছু প্রোগ্রাম (প্লাগ-ইনস) তৈরি করেছিলেন হাসিন হায়দার। তিনি জানান, নিয়মিতভাবে এগুলো অনেকেই ব্যবহার করছেন। সবার কাজের জন্য এর হালনাগাদও নিয়মিত করা হয় বলে জানান তিনি।
এ ছাড়া একুশে (www.ekushey.org) সাইটে রয়েছে বিভিন্ন ফন্ট এবং লে-আউট। বাংলা নিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন সুবিধা যুক্ত করা হয় এতে। বিভিন্ন ধরনের মুক্ত সফটওয়্যারের স্থানীয়করণ (লোকালাইজেশন) করছে অংকুর ফাউন্ডেশন। তারা জনপ্রিয় মুক্ত লেখালেখির সফটওয়্যার ওপেন অফিস ডট অর্গের (www.openoffice.org/download/other.html) জন্য তৈরি করেছে বাংলা স্পেল চেকার। এটি ওপেন অফিস বাংলা সংস্করণে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের রয়েছে ইউনিকোড ফন্ট নিকস ও কনভার্টার।

রয়েছে গুগল কি-বোর্ড
বিশ্বসেরা সার্চ ইঞ্জিন গুগলেও রয়েছে বাংলা কি-বোর্ড লে-আউট। www.google.com.bd ঠিকানায় সার্চ বক্সের ডান পাশে থাকা কি-বোর্ডটি মাউসের মাধ্যমে ব্যবহার করা যাবে এবং লেখা যাবে বাংলায়।

প্রয়োজন এগিয়ে আসার
মুক্ত অপারেটিং সিস্টেম উবুন্টুর বাংলা সংস্করণ রয়েছে, তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সফটওয়্যারগুলো বাংলায় ব্যবহারের জন্য স্থানীয়করণ করার কাজও হচ্ছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাতেই আমরা কম্পিউটারের সব কাজ করতে পারব—এ প্রত্যাশা সবার।
Ruby