শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১

রক্তস্নাত স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি

বাঘা নিউজ ডটকম, ১৬ ডিসেম্বর : মহান বিজয় দিবস আজ। রক্তস্নাত স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি। আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দিন। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করে বহু প্রাণ আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এদিনে দামাল বাঙালি ছিনিয়ে আনে বিজয়ের লাল সূর্য। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের মুক্তিকামী মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের পর এদিন আত্মসমর্পণ করে মুক্তিকামী মানুষের কাছে। আর পাকিস্তানি বাহিনীর এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে দীর্ঘ দুই যুগের পাকিস্তানি শোষণ আর বঞ্চনার। নির্যাতন, নিষ্পেষণের কবল থেকে মুক্ত হয় জাতি। স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবার ভিন্ন আঙ্গিকে পালন হচ্ছে মহান বিজয় দিবস। ৪০ বছরের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার বিশ্লেষণ হচ্ছে সর্বত্র। বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তিতে প্রবল হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী যু্‌দ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি। আজ পরম শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় পুরো জাতি স্মরণ করবে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী লাখো শহীদদের। যাদের জীবন উৎসর্গে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একই সঙ্গে প্রত্যয় ব্যক্ত হবে সমৃদ্ধ আগামীর বাংলাদেশ গড়ার। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পালিত হবে নানা কর্মসূচি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনভর পালন করবে বিজয় দিবসের কর্মসূচি। দিবসটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন। আজ সরকারি ছুটির দিন। দিবসটি উপলক্ষে আজ সকালে সারা দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পালিত হবে নানা কর্মসূচি।
সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে দিবসের কর্মসূচির সূচনা করবেন প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হবে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ। দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলোকে সাজানো হয়েছে জাতীয় ও রঙ-বেরঙের পতাকা দিয়ে। বিজয় দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে আজ জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। রেডিও-টেলিভিশনে প্রচার করা হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে মসজিদ, মন্দির ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে অনুষ্ঠিত হবে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার  তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে সূচনা হবে বিজয় দিবসের কর্মসূচি। দিবসটি উপলক্ষে প্রত্যুষে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ঢল নামবে সাধারণ মানুষের। বিজয় আবেগে উদ্বেলিত সাধারণ মানুষের ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে জাতীয় স্মৃতিসৌধ আর সকল শহীদ মিনার। দেশ জুড়ে উচ্চারিত হবে বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্রকণ্ঠ। দিবসটি উপলক্ষে জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত হবে বিশেষ কুচকাওয়াজ। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলোতে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিজয় দিবসের কর্মসূচি পালিত হবে।
১৯৪৭ সালে ইংরেজদের শাসন থেকে এদেশ মুক্ত হলেও ফের বাধা হিসেবে দেখা দেয় পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠীর অন্যায় শাসন। বাঙালি বঞ্চিত হতে থাকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ লুট করে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে তোলা হয় সম্পদের পাহাড়। তাদের সে অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিবাদে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে দামাল বাঙালি। ধাপে ধাপে আঘাত হানতে থাকে শাসনযন্ত্রে। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ’৫৭-র স্বায়ত্তশাসন দাবি, ’৬২ ও ’৬৯-এর গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মার্চে দুরন্ত বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামে। ২৫শে মার্চ কাল রাতে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী শুরু করে নির্মম নিধনযজ্ঞ। এরপর আসে মহান স্বাধীনতার ঘোষণা। দখলদার বাহিনীকে বিতাড়নে শুরু হয় অদম্য সংগ্রাম। ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে জীবন দান করেন লাখ লাখ বাঙালি। অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর আসে সেই কাঙ্ক্ষিত বিজয়। সে সময়ের রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়।
বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট তার বাণীতে বলেন, এ বছর বিজয়ের চল্লিশ বছর পূর্তি উদ্‌যাপিত হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই এবারের বিজয় দিবস উদ্‌যাপন তাৎপর্যপূর্ণ। ভৌগোলিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য। আত্মবিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবো আমরা মুক্তিযুদ্ধের সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য এখনও পুরোপুরি অর্জন করতে সক্ষম হইনি। শুরু থেকেই আমাদের প্রচেষ্টা ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট বলেন, বর্তমান সরকার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে ‘ভিশন-২০২১’ ঘোষণা করেছে। আমাদের বিপুল মানবসম্পদ ও তথ্যপ্রযুক্তির সার্থক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা এ ‘ভিশন’ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবো ইন্‌শাআল্লাহ।
বিজয় দিবসে দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণকে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। জাতির পিতার অবিসংবাদিত নেতৃত্বে বাঙালি জাতির দীর্ঘ ২৩ বছরের স্বাধীনতা-সংগ্রামের চূড়ান্ত ফসল ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও পরাজিত শক্তি থেমে থাকেনি। তারা হত্যা-ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। একই বছর ৩রা নভেম্বর জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। তারা ধ্বংস করতে চেয়েছিল সংবিধান, গণতন্ত্র, মানবতা, সংস্কৃতি, ইতিহাসসহ আমাদের মহত্তম অর্জনগুলো। আজন্ম সংগ্রামী বাঙালি জাতি জীবন দিয়ে, দীর্ঘ অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করেছে গণতন্ত্র এবং মানুষের অধিকার। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পবিত্র সংবিধানে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার পুনর্বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সকল হত্যাকাণ্ডের বিচারে সরকার বদ্ধপরিকর। তিনি বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপিত হবে। এ সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে দলমত নির্বিশেষে সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একটি সুখী, সুন্দর, শান্তিময় ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি: বিজয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয় ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারা দেশের সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন। সকাল আটটায় বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল সাড়ে ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। এছাড়া ঢাকা মহানগরীর অন্তর্গত সকল থানা শাখা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও জাতীয় সংসদ সদস্যগণ স্ব স্ব এলাকা থেকে  বিজয় র‌্যালি সহকারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান ঐতিহাসিক সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত হবেন ও সেখানে স্থাপিত শিখা চিরন্তনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় বিকাল ৪-২০ মিনিটে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এছাড়া আগামী কাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে যথাযোগ্য মর্যাদায় দেশের সকল শাখা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী ও সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
Ruby