মঙ্গলবার, ১ মে, ২০১২

মানুষের কবি ফকির লালন শাহ

undefined মানবতাকে অপমান করে এরূপ কোন ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিক বিধিবিধানের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। নিজস্ব মতবাদের পক্ষে তিনি ছিলেন আপসহীন। সামাজিক আচার-প্রথা, ধর্মীয় নিয়মনীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া মানবতাকে মুক্ত করাই ছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁর মূল লক্ষ্য। ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার উত্থান ঘটে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ উঠে যায়। সৃষ্টি হয় মনুষ্যত্বের প্রতি অপরিসীম মর্যাদা ও শ্রদ্ধাবোধ। মানুষের স্থান হয় সবার উপরে। এই রেনেসাঁর সব লক্ষণই ছিল লালনের দর্শনে। এ দর্শনের মূলে হলো মানবতা। মানুষ অখ-, মানবতা অভিন্ন। সেই মানুষ ভজনের কথা জোরালো কণ্ঠে বলেছেন লালন। তিনি মানবিক মূল্যবোধকে ঊর্ধে তুলে ধরেছিলেন। তাই তিনি অতিসহজেই বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারতেন। তাকে নিয়ে লিখছেন- মজির হোসেন চৌধুরী

কবিগুরু রবীন্দ্র নাথের মতে বাংলার শিক্ষিত সমাজ যে সংস্কৃতির চর্চা করে তা বৈঠকঘর কেন্দ্রিক সংস্কৃতি। এরই পাশে ড. আহমদ শরীফের মতে, বাউল মত বাঙলার ধর্ম। বাঙালির ধর্ম একান্তভাবে বাঙালির মানস ফসল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদহ অঞ্চলের এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল, আমি কোথায় পাব তারে/ আমার মনের মানুষ যে রে? হারায়ে সেই মানুষে,/ তাঁর উদ্দেশ্যে/ দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে। রবীন্দ্রনাথের লেখা গোরার বিনয়ভূষণ দোতালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন, রাস্তায় গান গেয়ে যাওয়া এক বাউলকে। সেই বাউলকে ঘরে ডেকে আনতে তিনি আগ্রহ বোধ করছিলেন। বাংলার সেই বাউলদেরই অন্যতম ফকির লালন শাহ।
তীর্থযাত্রার দল থেকে পরিত্যক্ত লালন সবার মাঝে থেকেও ছিলেন উদাসীন। নদীতে ভেসে একদিন লালনের ভেলা ছেঁউড়িয়া গ্রামে ভিড়েছিল। বসন্ত রোগে আক্রান্ত লালনের অবির্ভাব কালিগঙ্গা নদীর ঘাটে। মওলানা মলম শাহ্ ও তাঁর স্ত্রীর ক্রোড়ে সন্তানতুল্য আহ্লাল লাভ করেন। নিঃসন্তান মলম শাহ্ লালনকে পাঁচ একর জমি দান করেন। এবং সেখানে লালনের বসবাস। সেই লালন আজও জ্ঞানপিপাসু মানুষের কাছে এক রহস্য ঘেরা জ্ঞানের ভান্ডার।
লালন ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ১১৬ বছর। সেই আলোকে গবেষকদের ধারণা লালন শাহ্ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৭৭৪ সালে। হিন্দু ধর্মের লোকের দাবি- লালন ছিলেন হিন্দু, মুসলমানেরা বলেন, লালন ছিলেন মুসলমান। গবেষকদের মতে, লালনের পরিচয় ভিন্নরূপ। যেমন, মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী তাঁর লেখা বাউল সংগীত ও বাউল কবি লালন সাঁই প্রবন্ধে লালন ফকিরের হিন্দু ও মুসলমান দুটো পৃথক বংশ পরিচয় দেখিয়েছেন। দুটোর মধ্যে কোনটি ঠিক? অর্থাৎ চরম রহস্যেঘেরা লালনের জন্মপরিচয়। রহস্যের মাঝে ডুব দিয়ে লালন নিজে বলেছেন, সব লোকে কয়, লালন ফকির হিন্দু না যবন/ লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।
লালনের গোঁড়া ভক্তরা তাঁর জন্মকে অস্বীকার করেছেন। তারা লালনকে অবতার রূপে দাবি করেন। তাদের মতে, বাংলার উপেক্ষিত জনগোষ্ঠিকে উদ্ধারের জন্য লালনের আবির্ভাব ঘটেছে। তা না হলে লালন সাঁইয়ের জন্মরহস্য অজানা থাকত না। তিনি অতি সতর্কতার সঙ্গে নিজের পরিচয় গোপন করে গেছেন।খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতাম পাখির পায়।
একজন স্বল্পশিক্ষিত লোকের অন্তরে এ দশর্নচিন্তা তথা অচিন পাখি ঢুকলো কোন পথে? মানব ধর্মের দীক্ষা তিনি পেলেন কার কাছে? আসলে চৈতন্য, সুফী ও বাউলদের সহজীয়া ভঙ্গিতে তাঁর কণ্ঠে এসে যায় বাংলার চিরায়ত সুর। বাংলার নদী, মাঠ-ঘাট, বনানী, আকাশ, ঋতু পরিবর্তন, প্রকৃতি-পরিবেশ এ সবের মধ্য থেকে উত্থান ঘটেছে লালনের। জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, জলবায়ুর পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে ছেঁউড়িয়াকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বাউলের দেশ বাংলায় লালনের ছেঁউড়িয়া, বিল হাওর, নদী এবং মনের মানুষকে খুঁজে বেড়ায় অনেকে। কিন্তু মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া সহজ নয়। খুঁজতে গিয়ে জীবন কালটা ঘোরের মধ্যে কাটতে পারে। ধোঁয়াশায় চাঁদের আলোতে ভেসে বেড়াতে হয়। পথে পড়ে সুন্দর স্বর্গোদ্যান; নানা রঙের ফুল কুড়িয়ে নিয়ে মালা গাঁথা যায়। অপরূপ মায়ার চাদর বিছিয়ে দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। সেই চাদরে বসেই লালন করেছেন সাধনা। পরবর্তী কালে তাঁর শিষ্যরা বাংলার পথে ঘাটে ছড়িয়ে দিয়েছে লালন কথিত মানবতার বাণী। ফলে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান ঘটেছিল, তার বীভৎস চেহারাটি পাঞ্জাবের ন্যায় বাংলায় প্রভাব ফেলতে পারেনি। এ কৃতিত্ব পাওয়ার দাবিদারদের মধ্যে লালন শাহ্ অন্যতম একজন।
লালনের একটি দর্শন খুব কাছে টানে মানুষকে। তিনি বলেছেন, আমাদের জীবননৌকার দাঁড়টা কখনও কখনও কাউকে না কাউকে বাইতে হয়। তিনি বলেন, স্বধর্ম পালন কর কিন্তু তার জন্য অন্যকে আঘাত দিয়ে কর না। এটা সমকালীন সমাজে অনেকের ভাল লাগেনি। বর্তমানে এ দর্শন আবারো প্রয়োজন। এখন তো সারাক্ষণ মানুষে মানুষে বিভেদ লেগেই আছে। মানুষের সহিঞ্চুতা কমে গেছে। সহিষ্ণুতাই ছিল লালনের জীবনের ধর্ম। সে ধর্ম-পরিবেশ সৃষ্টি করতে গিয়ে লালন দেখেছেন কানার হাটবাজার। সাঁইজির দৃষ্টিতে সবাই কানা। কানা তার চরণতলে আলো দেখতে চায়। এই আলোর সন্ধান করেছেন হাজারো বাউল ভক্তরা। বাউল শিষ্যরা নিজেকে জানার বা চেনার চেষ্টা করেছেন।
মানব ধমের্র প্রচারক লালন শাহের মাজারে গেলে অহিংস লালনের ভক্তদের সীমাহীন বিশালতায় মন ভরে ওঠে। দূরদূরান্ত থেকে আসা বাউলদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে অনুষ্ঠিত হয় চৈত্রের দোলপূর্ণিমা উৎসব। তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে/ তোরা কেউ যাসনে ওই পাগলের কাছে। সেই পাগলের দরবারে প্রতি বছর দোলে একত্রিত হন গুরুশিষ্যরা। উদ্দেশ্য মানবতার প্রেম ও সাঁইজির দর্শন পাওয়া। গাওয়া হয় লালনের সব মধুর গান। গুরু-শিষ্যরা চৈত্রের পূর্ণিমা রাতে জোৎ�াছটায় গানে গানে হারিয়ে যায় ভিন্ন এক জগতে। উৎসবকে ঘিরে লালন ভক্তদের মাঝে সৃষ্টি হয় পরম উন্মাদনা। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গান করে ভক্তরা। অনায়াসে দেখতে পাবি/ কোনখানে সাঁই বারাম খানা/ আপন ঘরের খবর নেনা। সাঁইজির এমন অমিয় বাণী বাউল ভক্তদের মনে নাড়া দেয়। গুরু শিষ্যদের মধ্যে প্রকৃত প্রেম জাগায়। খুঁজে পায় আত্নার মিল। সাধুরা মনে করে এভাবে সাধু সঙ্গ করলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। সময় গেলে সাধন হবে না বাউলদের মতে এমন তত্ত্ব কথার মূল বিষয় হলো, অমাবশ্যায় পূর্ণিমা হয়, মহাজন সে দিনে উদয়। এর অর্থ এই মহাযোগে মহামানুষের আবির্ভাব হয়। দোলযাত্রার মাধ্যমে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় যে, সাধু গুরুর কৃপা ছাড়া মানুষ মুক্তি পেতে পারে না। লালনের মৃত্যুবার্ষিকীতে ছেঁউড়িয়ায় ১৬ অক্টোবর আর একটি স্মরণোৎসব বসে। ( আগামী পর্বে....)
Ruby