রবিবার, ১ জানুয়ারী, ২০১২

শিতা হার; (ছোট গল্প) প্রভাষক মকলেছুর রহমান টুটুল

লেখক-প্রভাষক মকলেছুর রহমান টুটুল ১ জানুয়ারী : পরাণ কুমার একজন দিনমুজুর। বাপ-দাদা পূর্ব পুরুষের পেশা ছিল মাটির জিনিস তৈরী করা। তারা কুমার সম্প্রদায় ছিল। আজকাল মাটির তৈলী জিনিসের কদর না থাকায় পরাণ পৈত্রীক পেশা ছেড়ে দিয়েছে। প্রতিদিন লোকের জমিতে কাজ করে সংসার চালায়। বলতে গেলে শরীরটাই তার একমাত্র সম্পদ। জমিজমা বলতে গেলে দশ কাঠার মত হবে তা আবার তার বাড়ীর ভিটা। জমি থেকে তার কোনই উপার্জন নেই। পরিবারে তাদের আটজন সদস্য। দুই ছেলে তিন মেয়ে আর বৃদ্ধপিতা নিয়ে পরিবার। পরাণের বিবির নাম কমলা রাণী। সে গৃহের কাজ করে। চরম দারিদ্র সীমার নিচে তাদের বাস। দুঃখ তার জীবন সঙ্গী।
  
  পরাণ সারাদিন খাটুনির পর যখন ঘুমাতে যায় তখুনি তার বিবির একই আবদার, এই স্বর্ণের শিতা হারটি কবে কিনি দিবা বলোনা ? প্রতিদিনি পরাণ কিনি দিবে বলে বিবিকে সান্তনা দিয়ে রাখে। সান্তনা দিবেনা ? তার অভাবের সংসার ছেলেপুলে নিয়ে তার সংসারটা কোনমতে চালানোই দায়। বর্তমান বাজার মূল্যে স্বর্ণের যা দাম তাতে শিতাহার কিনতে গেলে বাড়ির ভিটাটা বিক্রী করেও হবে কী না চিন্তার বিষয়।

  একদিন রাতে তার বিবি বেঁকে বসলো, স্বামীকে বলল- হার কবে কিনি দিবা আজই তোমাকে বলতি হবি, ওয়াদা করতি হবি। পরাণ বলল- এই তোর মনে কোন দয়া-মায়া নাই? আমার হাড়-মাংস জ্বালা খাচ্ছিস। রাত হলি খালি প্যান প্যান ঘ্যান ঘ্যান করিস। আমার উপর খালি চোটপাট। তুই কি সতীনের ঘর করছিস নাকি ? তোর মুখে খালি নাই নাই আর নাই, এই দেও ওই দেও বায়না ছাড়া কোন কথা পাশনি তুই ? আমি যেন মিয়া বিয়া করিনি বিয়া করিচি ভাংগা মটর ছাইকেল প্রতিদিন তেল দেও মবেল দেও কখন পার্টস্ লষ্ট। যত বিপদ আমার। তোর নামতো কমলা, নামের মানেতো শুনিচি লক্ষীদেবী ব্যাবহার মা কালির মত ক্যান ? কমলা কাঁদাকাটি শুরু করল। পরাণ বুঝায়ে বলল- আরে বাবা আমার অভাবের সংসার নুন আনতে পানতা ফুরাই। অবস্থা বুঝি ব্যাবস্থা। সুয়োগ বুঝি কিনি দিবনি, যা- এখন ঘুমা। আবার কমলা- নানা কোন জারিজুরি চলবিনা আজ ওয়াদা করতি হবি। পরাণের আর কোন উপাই নাই, সে ওয়াদা করে বলল- যেদিন আমার সামনে কিছু লোক পিছনে কিছু লোক আমি মধ্যি মধ্যি যাব সেইদিন তুই আমার কাছ থাকি হারটা নিস্। বিবি বলল- হ্যাঁ মনে থাকে যেন, সেইদিন কিন্তু হারটা দেওয়াই লাগবি ভুলি যাওনা আবার ? পরাণ বলল- হ হ ভুলবো মানি সেই দিনই নিস যা। মনে মনে বলতে থাকলো পাগলী মরার পরেই নিস্, কোন পাগলীর পাগলী জীবিত অবস্থাতেই পালোনা ? লাশের কাছ থাকি হার নিবি বুলে ? ঘুমানোর আগে গুনগুন করে গান ধরলো পরাণ-
আমার দেহ হইলো ইঁটের ভাটা
অন্তে ধিকি ধিকি জ্বলেরে
প্রাণপ্রিয়া দিয়াছে আগুন
সেই আগুনে আমি জ্বলেরে।।
 হাটের দিন বিবি বলল- হ্যাঁ গো ছেলেপুলেরা বড় মাছ খাতি চায় বাজারের বড় মাছটা একদিন কিনতি পারনা ? মাছ কিনলেই তো ছোট ছোট মাছ কিনি আনো। কাটিকুটি ধুয়ি রাঁধাও বিরক্তির কাজ। একই জিনিস খাতি ভালও লাগেনা। পরাণ আবার চিন্তাই পড়ল। আবার বাজারের বড় মাছটা কিনতি হবি ? সে বলল- আজ হাটে না, আর একদিন কিনি খাওয়াবো। পরাণ মহাচিন্তায় পড়ে গেলো, কি করে বাজারের বড় মাছটা কিনবে ? বাজারে যা মাছের দাম তাতে বড় মাছটি কিনতে হলে ৫০০/৭০০ টাকা লাগবে।
  অনেকদিন পর পরাণ অনেক কষ্ট করে মাছ কেনার জন্য ৫০০ টাকা জোগাড় করে হাটে রওনা দিল। বাজারে গিয়ে দেখলো বাজারে যে বড় মাছটি উঠেছে তার দাম ৭০০ টাকা। কীভাবে সে কিনবে বড় মাছ? তারতো তোবিল ই ৫০০ টাকা। মাছের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে সে চিন্তা করছে কি করা যায়, কি করা যায়। এমন সময় একজন লোক ঘোড়ার পিঠে থেকে নেমেই মাছটি কিনে নিলো আরও আশ্চর্য্যরে বিস্বয় বাজারের যত বড় বড় মাছ ছিল সব সে কিনে নিলো। দু-তিন মন হয়তো হবে। চারজন লোক মাছ গুলো মাথায় নিয়ে রওনা দিল। আগন্তক মানুষটি ঘোড়ার পিঠে চড়ে রওনা দিলেন পেয়াদা গুলো পিছুপিছু রওনা দিলো। পরাণ তাড়াতাড়ি করে ছেলেকে ছোট মাছ কিনে দিয়েই বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে ঐ লোগুলোর পিছু নিলো। বড় মাছ তার আজ আর কিনা হলোনা।
 তাকে অবশ্যই জানতেই হবে কেমন অবস্থাশালী ঐ ব্যক্তি যে কোন দামদর না করে এতগুলো মাছ কিনলেন। তাদের পিছুপিছু গিয়ে ঐ ধণী ব্যক্তির বাড়িতে পৌঁছে গেলো পরাণ। তখন সন্ধ্যা ৮টার মত হবে । পরাণ খুব আশ্চর্য হলো দেখলো বিশাল দমিদারী কারবার। কী সুন্দর পরিপাটি জমিদার বাড়ির মতই বাড়ি। শতশত লোক বিভিন্ন কাজে ব্যস্থ সবাই। পরাণ বাড়ির গেটে গেল দারোয়ানকে বলল- ভাই আমি একজন মুসাফির, আজ রাতটা তোমাদের এখানেই কাটাতে চাই ব্যব¯থাটা তোমাকেই করি দিতে হবি। দারোয়ান পরাণকে ভীতরে নিয়ে গিয়ে অতিথি শালায় নিয়ে গেল। সে বাড়ির মালিকের নাম জিজ্ঞাসা করল- তাঁর নাম মনিন্দ্রনাথ ভূঁইয়া। তিনি আসলেও জমিদারেরই বংশধর।

 রাতে খাবারের সময় হল, খাবার সামনে আসলো মুসাফির মনে করল যাক অনেকদিন বড় মাছ খাইনি আজ খাওয়া হবিনি। এত বড় মাপের মানুষের বাড়িতে আসনু একপিছ মাছ তো আমার বরাতে আছেই। অবাক করা বিষয় একপিচ মাছ ও তার ভাগ্যে জোটেনি। সে শাক্-সব্জী দিয়েই খাওয়া শেষ করে যে লোকটি তাকে খাবার এনে দিল তাকে জিজ্ঞাসা করল- ভাই দেখলাম হাট থাকি অনেক মাছ কিনি আনা হল তা কি পাক হয়নি ? লোকটি বলল- আর বলোনা ভাই এটা একটা রাবনের পূরী, এখানে এতই লোক সংখ্যা যে, এত মাছ সব খেয়ে শেষ। কি বলবো ভাই আমার ভাগ্যেও জোটবে কিনা ভরসা নাই।

 অনেক রাত হয়ে গেল পরাণ বাড়িতে ফিরেনি। কমলা চিন্তায় পড়ে গেল, যে ছেলের সাথে স্বামী বাজারে গিয়েছিল তাকে জিজ্ঞাসা করতে থাকলো- কিরে তোর বাবা বাড়িতে এখোনা আসলোনা কোথাই গেলো তোক বুলি যায়নি ? ছেলে বলল- না মা আমাকে কিছুই বলেনি, শুধু দেখনু বাবা এমন তাড়াহুড়া করলো যে মনে হলো কোন অনুষ্টানে যাবি। কমলা ভাবছে- কোথাই যাতি পারে মানুষটা, তিন কুলে তারতো
একবারে ঘনিষ্ট আত্বীয় কেউ নাই। আমার বাপের বাড়ি তো তিন জিলা দূর যাতি ৫/৬ ঘন্টা লাগে, সন্ধ্যা কালে কিভাবে যাবি, আমাক বুলি যাবিনি ? কোথাই গেল মিনশি?

 রাতে না খেয়ে কমলা বিছানায় গেল। কোনমতেই ঘুম আসছেনা চোখে। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছে, পাশে স্বামী নাই। আজ কমলা বুঝতে পারছে স্বামী কী জিনিস। প্রতিদিন স্বামীর কাছে কত ছোটবড় বায়না করতো, তার বড় বায়না ছিল স্বামীর কাছে শিতাহার। এমন ভাব দেখাতো স্বামীর জন্য তার কোন ভালোবাসাই নাই। আজ এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে বুঝতে পারছে স্বামী কী ধন। মর্মাহত হয়ে সে কাঁন্নাকাটি শুরু করেদিল। প্রতিজ্ঞা করল আর কোনদিন স্বামীর কাছে শিতাহারের কথা বলবেনা। আজ টের পেল স্বামীই হচ্ছে একজন নারীর জীবনে অমুল্যধন। শিতাহার তার কাছে কিছুই না। স্বমীকেই যতন করে গলার মালা করে রাখতে হবে।
এদিকে পরাণেরও ঘুম আসছেনা। মুখে আস্তে আস্তে বলতে থাকলো, ‘এটা একটা রাবনের পূরী, এটা একটা রাবনের পূরী’। গভীর রাত শাস্ত পরিবেশ। ভূঁইয়া সাহেব দোতলার ঊপর থেকে রাবন রাবন কথা শুনতে পেলো। রাতে তাঁরও ঘুম আসছেনা চোখে। সে তাঁর বিবিকে বলল- একটা গল্প বলোনা ? বিবি বলল- কী গল্প বলবো ? রাবনের গল্প বলো। বিবি বলল- রাবনের গল্প তো আমি  ভালো মতো জনিনা। ভূঁইয়া সাহেব বলল- তাহলে দেখো, বাহিরে কে যেন রাবনের গল্প করছে সে হয়তো রাবনের কাহিনী জানে তাকে ডেকে নিয়ে আসার ব্যাবস্থা করো। বাড়িতে যত লোক ছিল সকলকে ডেকে বলা হল কে জানো রাবনের গল্প সাহেবকে শোনাও। বাড়ির সবাই হাত উঠায়ে বলল, আমরা জানিনা। পরাণ বলল- সাহেব আমি আজ রাতে আপনার বাড়ির মুসাফির, আমি রাবনের গল্পের অল্প বিস্তর জানি, যদি শুনেন- শুনাতে পারি। পরাণ রাবনের কাহিণী বলা শুরু করলো এবং যতটুকু যানে ততটুকু শোনালো। ভুঁইয়া সাহেব বলল- তাহলে রাবনের পূরী কীভাবে ধ্বংস হল বলো ?
পরাণ বলল- গল্প শুনবেন না প্যাকটিক্যাল দেখবেন ? সাহেব বললেন- আরে বাবা প্র্যাকটিক্যাল হলে কেউ গল্প শোনে, পাগলতো দেখছি। পরাণ- দেখবেন তাহলে ? সাহেব - হ্যাঁ দেখাও। পরাণ বলল তাহলে একটি বিড়াল ধরি আনেন। বিড়াল ধরে আনা হল পরাণ বিড়ালটি ধরে বাহিরে নিয়ে গিয়ে তার নেজে একটুক্রা কাপড় বেঁধে আগুন ধরিয়ে ছেড়ে দিল তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বিড়াল যে ঘরে যায় সেই ঘরেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলা শুরু হল। সত্যি সত্যি তখন রাবনের পূরী ধ্বংস শুরু হল। চারিদিকে আতংক! আগুন,আগুন। অনেক লোকের বাসা তাড়াতাড়ি আগুন নিভিয়ে ফেলা হল। পরাণ জোরে জোরে বলতে লাগলো, এই ভাবেই রাবনের পূরী ধ্বংস হইছিল। আর মনে মনে গালি দেয় আর বলে, শালার ব্যাটা তিন মন মাছ কিনিছিস্ আর একপিচ আমার ভাগ্যে জোটেনা ? তোরা তো রাবনের মতই দুনিয়া খায়া শেষ করবি। রাবন নাকি রাগ করি পাহাড় ধরি আছাড় দিছিল আমিও তোকে এমন ভাবে আছাড় দিতি চাইছিনু, যে তোর মাজা আর কোনদিন সোজা না হয় । সে কি আর রেহাই পাই ? বাড়ির সকল চাকরবাকর মিলে তাকে ধরে দশেবিশে পেটানো শুরু করলো যেন বিড়ালকে ধরে বস্তায় বন্দী করে মারা হচ্ছে। পরাণের আর কোন নড়াচড়া নেই একেবারে নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সবাই তাকে ছেড়ে দিয়ে সরে গেল একজন কাছে গিয়ে দেখলো তার মহান আত্বাটি ততক্ষনে দেহধাম ছেড়ে স্বর্গে পৌঁছে গেছে। মাটিতে পড়ে আছে শুধু একেবারে ক্লান্ত অসাঢ় দেহছায়া খানা।
হায় হায় একি হল লোকটি তো মারা গেছে। ভুঁইয়া সাহেবের কাছে সংবাদ পৌঁছে গেল। লাশের কী করা যায়। লাশটা পোড়ানো যাবেনা জানাজানি হয়ে যাবে। রাতও বেশী নেই ভোর হয়ে আসছে। বুদ্ধি আঁটলো লাশ নদীতে ফেলে দিতে হবে। তাড়াতাড়ি লাশ নিয়ে কয়েকজন নদীর পানে রওনা দিল। পরাণের বাড়ির কিছুটা দূর নদীপথ। ঐ রাস্তা দিয়ে লাশ নিয়ে তারা যাচ্ছিল। পরাণের স্ত্রী ভোরে ছেলেকে সাথে করে স্বামীকে খোঁজার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। সে দেখতে পেলো সামনে কিছু লোক পিছনে কিছু লোক খাটলির উপর একজন শুয়ে আছে, ওদের জিজ্ঞাসা করলো কাকে ওমন ভাবে নিয়া যাচ্ছ ভাই? চট্ করে একজন বলল, এটা একটা বেওয়ারিশ লাশরে বোন। সত্যি কোনদিন চাপা থাকে? কমলা বলল- নামাওতো দেখি কার লাশ। ওনাদেরও ঘাড় ধরে গেছে তাই লাশ মাটিতে নামালো। কমলা লাশের পাশে গিয়ে আস্তে কাপড়টা সরিয়ে চোখ পড়তেই- কী হৃদয় বিদারক, বিয়োগান্তক পরিস্থিতি সৃস্টি হল দর্শক বুঝতেই পারছেন। কমলার তখন শুধুই বুক চাপড়ানি আর আহাজারি। তার পাশে একমাত্র ছেলে ছাড়া কেউ নেই, কে তাকে এমন সময় সাহায্য করবে। লোকগুলো তাড়াতাড়ি করে লাশ নিয়ে পালালো। হায় বিধাতা এমন অবস্থাতে তো কমলার শিতাহার পাবার কথাছিল কিন্তু আজ কমলার কাছ থেকেই তার সবচেয়ে দামি হার ছিনিয়ে নেওয়া হল সাথে তার নারী সতীত্বের অহংকার সিঁথির শিঁদুরও নদীতে বিষর্জন দেওয়া হল। নিয়তী এমন কঠোর হতে পারলো? এমন পরিণতি যেন কারো জীবনে না আসে।                                    (শেষ)


















Ruby