শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১১

শীতের আদরে সেজে ওঠা মতিহার

বাঘা নিউজ ডটকম, মাহাবুব আলম, ৩০ ডিসেম্বর : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) আইন ও বিচার বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাইট গত সোমবার তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছিল কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে দিয়ে। তাড়াহুড়োর কারণ জানতে চাইতেই বললেন, সকাল ৯টায় ক্লাশ রয়েছে। এখন বাজে সোয়া ৯টা। শীতে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় ক্লাশে দেরি হয়েছে।’ ক্লাশে উপস্থিত হতেই তার এই তাড়াহুড়ো।

এটি শুধু রাইটের ঘটনা নয়, শীতের সকালগুলোতে ঠিক সময়ে উপস্থিত হতে শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী, কর্মচারী সবারই যেন একটু দেরি হয়। শীতের অলস সকালে পরশ, বৃক্ষের সবুজ আদরকে সঙ্গী করে চোখে ঘুম নিয়ে শিক্ষার্থীরা ছুটে চলেন ক্লাশ আর পরীক্ষায়। কুয়াশার চাদার ভেদ করে রাবি ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের আড্ডায় মুখরিত হতে একটু সময় নেয়। পায়ে মোজা থেকে মাথা অবধি জড়ানো থাকে শীতের হরেক রকম পোশাক। তবে ক্লাশে এক জায়গায় কতক্ষণ বসার পরে আবার উঠতে অলস দেহ বাধা দেয়। এমন দিনে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সকাল আটটার ক্লাশে আসতে হিমশিম খেতে হয়। সবুজ সামিয়ানায় বিছানো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। এখানে সবুজের বাঁকে কুয়াশার হাতে বন্দি উষ্ণতার অধীশ্বর সূর্য। পাখির সরব মাখা ভোর। আর হিম সকালে নীরব মায়ায় শীত মানেই এখানে প্রশান্ত নদীর শাণিত বুক।

এতোসবের মধ্যে শীত কিন্তু আড্ডাবাজদের জন্য একটু বাড়তি উচ্ছ্বাস নিয়ে আসে। কবি মহাদেব সাহা বলেছেন, ‘শীত হচ্ছে মিলনের ঋতু। বর্ষা বিরহের। হেমন্ত আসে শীতের বার্তা নিয়ে। শীতের মাধুর্য রয়েছে। বাংলার শীত মৃদু, উপভোগ্য। পশ্চিমা শীতের সর্বগ্রাসী ও বীভৎস রূপ আমাদের প্রকৃতিতে চোখে পড়ে না। এ সময় বাংলার প্রকৃতি ধূসর, কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। শীতে প্রকৃতির এই জীর্ণ রূপ আমাদের মনে করিয়ে দেয় রূপান্তরের কথা, পরিবর্তনের কথা। কেননা, শীতের পরেই তো বসন্ত। জীর্ণতা কাটিয়ে জীবন ধাবিত হবে যৌবনের দিকে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডাবাজ বন্ধুদের কলকাকলিতে কেটে যায় কুয়াশার বান। বিশেষ করে সন্ধ্যা কিংবা বিকেলে তাদের আকুলি করা হৈ হৈ রবে শীতের সকাল অলসতা প্রাণবন্ত হয় আড্ডায়। সকালের সূর্যের আলো ছড়াতে ছড়াতে ক্যাম্পাসের টুকিটাকি চত্বর, মিডিয়া চত্বর, ইবলিশ চত্বর,  বাসস্ট্যান্ডসহ প্রতিটি ভবনের সামনের চায়ের দোকানগুলোতে বসে বন্ধুদের আড্ডা। নানান ইস্যুতে চলতে থাকা আড্ডার পাশাপাশি রয়েছে গরম চায়ের কাপে চুমুক। শীতের সকালগুলোতে সামান্য ফুসরত পান না চায়ের দোকানিরা। চায়ের কাপে চিনি দিতে দিতে মিডিয়া চত্বরের আলম জানান, অন্যান্য সময়ের চাইতে শীতে বেড়ে যায় চা বিক্রি। বলতে গেলে তা প্রায় দ্বিগুণ।’ তবে কুয়াশামাখা সকালে চা বানাতে বানাতে ঠা-া হয়ে যায় বলে তিনি জানান। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে হতে মুখরিত হয়ে ওঠে রাবি ক্যাম্পাস।

দেশের অন্য জেলার চাইতে পদ্মাপাড়ের রাজশাহীতে শীত যেন একটু বেশি। গত সপ্তায় বেশিরভাগ দিন দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিলো রাজশাহীতে। এ মৌসুমে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পুরাতন শিক্ষার্থীদের কাছে এ পরিবেশ পরিচিত হলেও নতুনদের কাছে একেবারেই অন্যরকম। রাবির ই-ইউনিটের লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হতে টাঙ্গাইল থেকে এসেছেন সাবরিনা মিতু। তিনি জানালেন, ভর্তি হতে এসে থাকতে হচ্ছে তিনদিনের জন্য। শীতের পর্যাপ্ত কাপড় না নিয়ে এসে বিপদে পড়ে গেছি। রাজশাহীতে এতো শীত আগে জানলে এমনটা হতো না।’ তবে ভর্তি পরীক্ষার সময়কার রাবি আর এখনকার শীতকালের রাবির মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন অনেক পার্থক্য। শীতের রাবি ক্যাম্পাসকে অনেক উপভোগ করছেন বলে মিতু জানান।

শীত আড্ডাপ্রেমী ও ফ্যাশন প্রিয়দের জন্য সুখকর হলেও ছিন্নমূল মানুষের জন্য বয়ে আনে অসহনীয় কষ্ট। শীতের ভোরে ক্যাম্পাসে এসে খাবার দোকানগুলোতে কাজে যোগ দিতে হয় অনেক শিশুকেই। বাসস্ট্যান্ডের খাবার দোকানে কাজ করে ইকবাল নামের ১৩ বছরের এক ছেলে। সে জানায়, শীতের সকালে সূর্য তার আলো ছড়ানোর কাজ শুরুর আগেই ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে এসে যোগ দিতে হয়। কাজ না করলে তার খাবার জুটবে না। তবে ছুটির দিনের শীতের দিনগুলো কিছুটা উপভোগ করে বলে ইকবাল জানায়।

শীতকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে জমে উঠেছে নানা রকম মৌসুমী ব্যবসা। ক্যাম্পাসের বাসস্ট্যান্ডে গড়ে উঠেছে গরম কাপড়ের মৌসুমী মার্কেট। নানারকম শীতবস্ত্রের সঙ্গে রয়েছে চাদর, মাফলার, জুতা, মোজা ইত্যাদি। এখানকার বিক্রি মূলত সকাল থেকে দুপুরের শেষ বাস ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত। সেখানকার দোকানিরা জানালেন, শীতের শুরুতে বিক্রি বেশি হয়েছে। এখন বিক্রি হলেও কিছুটা কমে গেছে। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই আবার বিক্রি বাড়বে বলে তারা জানান। বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে প্রয়োজনীয় শীতের কাপড় কিনে নেন শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

হিমেল সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের আড্ডা জমে স্টেডিয়াম, শহীদ মিনার, সাবাস বাংলাদেশ মাঠ, ইবলিশ চত্বরসহ অন্যান্য স্পটে। তবে শীত যদিও কষ্টদায়ক, তবে ফ্যাশনপ্রিয় শিক্ষার্থীদের কাছে এক আনন্দের নাম শীতকাল। রঙ-বেরঙের মাফলার, গরম জিন্স শার্ট-প্যান্ট, স্যুট কোর্ট, ক্যাটসসহ বাহারি পোশাকের ফ্যাশনপ্রিয়দের মুগ্ধ করে। শীতকে কেমন উপভোগ করেন জানতে চাইলে সমাজকর্ম বিভাগের রাসেল বলেন, ‘শীত আসে আনন্দ আর ভ্রমণের বার্তা নিয়ে। বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় এমন দিনে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডার বেশি সুযোগ মেলে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘শীত’ কবিতায় বলছেন, শীত-হাওয়া জেগে ওঠে, ধেনু ফিরে যায় গোঠে, বকগুলো কোথা উড়ে চলে। আখের ক্ষেতের আড়ে, পদ্মপুকুর-পাড়ে সূর্য নামিয়া গেল ক্রমে। হিমে-ঘোলা বাতাসেতে কালো আবরণ পেতে খড়-জ্বালা ধোঁওয়া ওঠে জমে।’ এভাবেই রাত নেমে আসে, রাবি ক্যাম্পাসে সবাই ফিরে যায় আবাসিক হলগুলোতে। আড্ডাপ্রিয়রা নিজ নিজ কক্ষে লেপের ভেতরে


Ruby