রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১১

শাঁকা শিল্পের গ্রাম জামনগর

বাঘা নিউজ ডটকম, আমানুল হক আমান, ৪ ডিসেম্বর : রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৩৯ কিলোমিটার পূর্বদিকে বাঘার আড়ানী পৌরসভার পার্শ্ববর্তী নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর শাঁকারীপাড়া। উপজেলার জামনগর ইউনিয়নের নিভৃত পল্লীতে গড়ে উঠেছে  শাঁকা শিল্প। এখানকার ৯৫টি পরিবার শাঁকা শিল্পের সাথে জড়িত। তবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে শাঁকা শিল্পের প্রয়োজনীয় উপাদানের মূল্য বৃদ্ধিতে ধ্বংসের পথে বসেছে বিরল এশিল্পটি। তৈরীর কাজে ব্যস্ত শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় চৌদ্দপুরুষ ধরে গ্রামের বেশ কয়েকটি গোত্র শাঁকা তৈরীর কাজ  করে আসছে। ফাগুন ও চৈত্র মাসে শাঁকা তৈরীর ধুম পরে যায়। এ সময় প্রচুর পরিমানে শাঁকা তৈরীর কাঁচামাল শঙ্কর (সামুদ্রিক শামুক) খুলনা, বাগেরহাটসহ সমুদ্র এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়। শাঁকা তৈরীর কারিকররা শঙ্কর (শামুক) সংগ্রহ করে বাড়িতে এনে মেশিনের সাহায্যে কেটে, তাতে আটা দিয়ে আটকিয়ে তৈরী করা হয় শাঁকা। প্রতি জোড়া শাঁকার কাঁচামাল ১২ থেকে ২০ টাকা পিচ ক্রয় করে আনতে হয়। বাড়িতে  শঙ্করগুলি পরিস্কার করে মেশিনের সাহায্যে বিভিন্ন ভাবে নক্সা আঁকিয়ে তা বাজারে বিক্রয় করা হয়। শঙ্করের টুকরাগুলি আটা দিয়ে জোড়া লাগানোর পর তার উপর বিভিন্ন নক্সা আঁকা হয়। এক জোড়া শাকা তৈরী করতে ৫০ টাকা থেকে ৮০ টাকা খরচ হয়। প্রতি জোড়া শাঁকা বাজারে ১৫০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা বিক্রয় করা হয়। প্রকার ভেদে ১২০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত একটি শাঁকা বিক্রয় করা হয়। বর্তমানে দেশে উর্ধ্বগতির বাজারে শাঁকা তৈরীর কাচামাল শঙ্করের (শামুকের) দাম বেড়ে যাওয়াতে লাভ কম হচ্ছে বলে তারা জানান। একজন শাঁকা তৈরীর কারিগর প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ জোড়া শাঁকা তৈরী করতে পারে। এতে তার ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা থাকে।

শাঁকা তৈরীর কাজে ব্যস্ত কালিপদ বলেন, ১০ বছর ধরে শাঁকা বানানোর কাজ করছি। প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ জোড়া শাঁকা তৈরী করতে পারি। এতে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আয় হয়। এ কাজ করতে কালিপদর স্ত্রী তার স্বামীকে সাহায্য করে। উভয় মিলে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। শাঁকারী স্বদেপ বলেন, শাঁকা তৈরী করে ৫ সদস্যের পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। পরিবারের ছোট-বড় সবাই মিলে শাঁকা তৈরী করি। বর্তমানে শাঁকার কাঁচামাল শঙ্করের (শামুক) ও এমাফোক্স আটার দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে লাভ কম হচ্ছে। আগের চেয়ে এখন মুলধনও বেশি। ১০ হাজার টাকা নিয়ে প্রথমে এ ব্যবসা শুরু করি। তখন শঙ্করের দাম কম ছিল। কিন্তু এখন এর দাম অনেক বেশি। স্বল্প সুদে ঋণ দিলে এ শিল্পকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম। তিনি আরো বলেন, আদি পুরুষরা শাঁকা বানাতো, আমরা সেই পেশাকে ধরে রেখেছি মাত্র। মুলধন নেই। ঋণ নিয়ে এ কাজ করে বেশি লাভবান হওয়া যায় না। বাসুদেপ বলেন, পুজির অভাবে বেশি মালামাল কিনতে পারিনা। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সহজ মুনাফার মাধ্যমে ঋণ দিতে হবে। জানা গেছে, শাঁকা শিল্পের সাথে জড়িতরা ২/৪ জন ছাড়া সবাই ভূমিহীন। বসতভিটা ছাড়া তাদের কিছুই নেই। তারা গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশাসহ বিভিন্ন এনজিও‘র ঋণে জর্জরিত। ব্যাংক ঋণ তাদের ভাগ্যে জোটে না। তারা প্রায় ১২ মাসই শাঁকা তৈরী করে। তবে ফাগুন ও চৈত্র মাসে শাঁকার ভরা মৌসুম বলা হয়। কারন এ সময় প্রচুর পরিমানে শঙ্কর পাওয়া যায়। স্বদেপ বলেন, শাঁকা তৈরী বার মাস করা তাদের পক্ষে সম্ভব যাদের বেশী মুলধন আছে। অনেক সময় বসে থাকতে হয়। টাকার অভাবে শঙ্কর কিনে রাখতে পারি না। তাই মৌসুম শেষ হলে অন্যান্য কাজ করতে হয়। অনেকে এ সময় বেশী করে শঙ্কর কিনে রাখে এবং বার মাস তারাই শাঁকা তৈরী ও বিক্রয় করে। ডলি, মায়া রানী, সুবলাসহ একাধিক পবিরারের সাথে কথা বলে শাঁকা তৈরীতে তাদের সাফল্যর কথা জানা গেছে। তাছাড়া শাঁকা তৈরী করার সময় যে পাউডার বের হয় তা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। প্রতি কেজি পাউডার ১০০০ হাজার থেকে ১২০০ টাকা কেজি বিক্রয় করা হয়। এ পাউডারগুলো বিভিন্ন কোম্পানীর লোকজন তাদের কাছ থেকে কিনে প্রক্রিয়াজাত করে উন্নতমানের ক্রীম তৈরী করে। তাছাড়া অনেক মানুষ শাঁকার পাউডার কিনে নিজেরাই মুখে ব্যবহার করে। এ পাউডার মুখের বর্ন, ম্যাছতা, কালো দাগসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েরা কুমারী থেকে বিবাহিত জীবনে ফিরে গেলে তাদের বিয়ের স্মৃতি স্বরুপ হাতে শাঁকা কপালে সিঁদুর পরে সাত পাকে বাধা পরে যায় স্বামীর বাড়িতে। সেই থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েদের বিয়ে হলে শাঁকা ব্যবহার বাধ্যতামূলক। বর্তমানে তারা শাঁকা তৈরী করে সাফল্য পেলেও প্রয়োজনীয় মুলধনের অভাবে অনেকেই শাঁকা তৈরীর কাজ ছেড়ে দিয়েছে। তারা আরো বলেন, সরকারীভাবে সল্প সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করলে তারা এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পারবে।
Ruby