শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১১

আ.লীগ নেতা রাজ্জাক আর নেই

বাঘা নিউজ ডটকম, আমানুল হক আমান, বাঘা (রাজশাহী) ২৪ ডিসেম্বর : মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক আর নেই। লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। (ইন্নালিল্লাহে............রাজিউন)।
হাসপাতালে গত ২০ ডিসেম্বর থেকে তিন দিন লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিলো আবদুর রাজ্জাককে। চিকিৎসকরা এরই মধ্যে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করলেও ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়নি। হাসপাতাল থেকে পরিবাররের একজন সদস্য জানিয়েছেন, আবদুর রাজ্জাকের স্ত্রী ফরিদা রাজ্জাক চিকিৎসকদের অনুরোধ করেছেন একজন মৌলভী ডেকে তওবা পড়ানোর পড়েই লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়ার জন্য। ফরিদা রাজ্জাক তার স্বামীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে সকলের প্রতি দোয়া চেয়েছেন।  প্রবীণ নেতা রাজ্জাকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদসহ নেতৃবৃন্দ শোক প্রকাশ করেছেন। আবদুর রাজ্জাকের সংগ্রামী জীবন : পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে আওয়ামীলীগের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা আব্দুর রাজ্জাক এদেশের মানুষের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে বিশেষ অবদান রাখেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা দীর্ঘদিন রোগ ভোগের পর গতকাল লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ৫০’র দশকের শেষের দিকে। সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের বর্তমান উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ছাত্রজীবন থেকে আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত হয়ে পড়ায় তখন থেকেই অত্যাচার নির্যাতন, জেল-জুলুম ভোগ করেন। আব্দুর রাজ্জাক শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার দক্ষিণ ডামুড্যা গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৪২ সালের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ইমাম উদ্দিন এবং মাতার নাম বেগম আকফাতুন্নেছা। ১৯৫৮ সালে আব্দুর রাজ্জাক ডামুড্যা মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং পরে মাস্টার্স পাস করেন। এরপর তিনি এলএলবি পাস করেন এবং ১৯৭৩ সালে আইনজীবী হিসেবে বার কাউন্সিল’র নিবন্ধিত হন। আব্দুর রাজ্জাকের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে। তিনি ১৯৬০-৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৬২-৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র-ছাত্রী সংসদের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তার নির্বাচনী এলাকা শরীয়তপুর-৩ (ডামুড্যা-গোসাইরহাট)। ১৯৬৩-৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের সহ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ থেকে ’৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি পর পর দুই বার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ থেকে ’৭২ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের  স্বেচ্ছাসেবক বিভাগের প্রধান ছিলেন। আব্দুর রাজ্জাক ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ’৭৫ সাল থেকে ’৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি বাকশালের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৮ থেকে ’৮১ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে তিনি বাকশাল গঠন করেন এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি এই বাকশালের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯১ সালে বাকশাল বিলুপ্ত করে তিনি আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ’৯১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলের পর তিনি দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য আব্দুর রাজ্জাক স্বাধীনতার পর সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে আব্দুর রাজ্জাক সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। ৯০’র দশকের শুরুতে শহীদ-জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে গণ আন্দোলন শুরু হয় সে আন্দোলনে আব্দুর রাজ্জাক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আব্দুর রাজ্জাক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন।রাজনৈতিক জীবনে আব্দুর রাজ্জাক বহুবার গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং জেল-জুলুম ও কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬৪ সালে প্রথম তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ’৬৫ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন। কারাগার থেকেই মাস্টার্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এরপর ৬ দফাআন্দোলনকরতে গিয়ে ১৯৬৭ সাল থেকে ’৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘাতকরা হত্যা করার পর আব্দুর রাজ্জাক পুনরায় গ্রেপ্তার হন। ’৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি কারাবন্দী ছিলেন। এরশাদের শাসনামলে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৭ সালে আব্দুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করা হয়।  পাকিস্তান আমলে ৬ দফা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আব্দুর রাজ্জাক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে আব্দুর রাজ্জাক ভারতের মেঘালয়ে মুজিব বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার (মুজিব বাহিনীর ৪ সেক্টর কমান্ডারের একজন) ছিলেন। তিনি মুজিব বাহিনীর একজন সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষকও ছিলেন। তিনি দেরাদুনে ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেল উবানের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। মুজিব বাহিনী গঠনে অন্যতম রূপকার ছিলেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আব্দুর রাজ্জাক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পানিসম্পদমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৯৭ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জাতীয় সংসদে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ২০০৯ সালের জুলাই-আগস্টে একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প পরিদর্শন করে। দেশে ফিরে আব্দুর রাজ্জাক সংসদে রিপোর্ট দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হবে এমন কোনো প্রকল্প ভারত বাস্তবায়ন করবে না বলে সেদেশের মন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলা এবং সন্ত্রাস দুর্নীতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে আব্দুর রাজ্জাক আজীবন লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। এছাড়া তিনি শান্তি আন্দোলনেও অবদান রেখেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। আব্দুর রাজ্জাক ফরিদা রাজ্জাককে বিয়ে করেন এবং তিনি দুই পুত্র নাহিম রাজ্জাক ও ফাহিম-রাজ্জাকের পিতা। (সূত্র এফএনএস)

                   

Ruby