সোমবার, ২ জানুয়ারী, ২০১২

নাটোরের শাঁখারী শিল্প হুমকির মুখেঃ দিশেহারা অর্ধ শতাধিক পরিবার


বাঘা নিউজ ডটকম, এম, এম আরিফুল ইসলাম, নাটোর : নাটোরের জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে জামনগর শাঁখারী পাড়া। জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর ইউনিয়নের এই নিভৃত গ্রামটিতে গড়ে উঠেছে শাঁখা শিল্প। এখানকার অর্ধশতাধিক পরিবার শাঁখা শিল্পের সাথে জড়িত । তবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে শাঁখা শিল্পের প্রয়োজনীয় উপাদানের মূল্য বৃদ্ধিতে পুঁজি সংকটে ধ্বংসের পথে বিরল এ শিল্পটি। পুঁজি সংকট এবং ঋনের জালে দিশেহারা শাঁখারী শিল্পের সাথে জড়িত এসব পরিবার।
শাঁখা তৈরীর সাথে জড়িত শিল্পীরা জানান, প্রায় চৌদ্দপুরুষ ধরে জামনগরের শাঁখারী পাড়া গ্রামের নাগ, সেন, ধর সহ বেশ কয়েকটি গোত্র শাঁখা তৈরীর কাজ করছে। ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে শাঁখা তৈরীর ধুম পড়ে যায়। এ সময় প্রচুর পরিমানে শাঁখা তৈরীর কাঁচামাল শঙ্কর (সামুদ্রিক শামুক) খুলনা, বাগেরহাটসহ সমুদ্র এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়। শাঁখা তৈরীর কারিগররা শঙ্কর (শামুক) সংগ্রহ করে বাড়িতে এনে মেশিনের সাহায্যে কেটে, তাতে আঠা দিয়ে আটকিয়ে তৈরী করা হয় শাঁখা। প্রতি জোড়া শাঁখার কাঁচামাল ১২ থেকে ২০ টাকা পিচ ক্রয় করে আনতে হয়। বাড়িতে শঙ্কর গুলি পরিস্কার করে মেশিনের সাহায্যে বিভিন্নভাবে নক্সা আঁকিয়ে তা বাজারে বিক্রয় করা হয়। শঙ্করের টুকরাগুলি আঠা দিয়ে জোড়া লাগানোর পর তার উপর বিভিন্ন নক্সা আঁকা হয়।
এক জোড়া শাঁখা তৈরী করতে ৫০ টাকা থেকে ৮০ টাকা খরচ হয়। প্রতি জোড়া শাঁখা বাজারে ১শ’ ৫০ টাকা থেকে ৮শ’ টাকা বিক্রয় করা হয়। প্রকার ভেদে ১২শ’ টাকা থেকে ২৫শ’ টাকা পর্যন্ত একটি শাঁখা বিক্রয় করা হয়। তাছাড়া শাঁখা তৈরী করার সময় যে পাউডার বের হয় তা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। প্রতি কেজি পাউডার ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকা কেজি ধরে বিক্রয় করা হয়। এ পাউডারগুলো বিভিন্ন কোম্পানীর লোকজন শাঁখারীদের কাছ থেকে কিনে প্রক্রিয়াজাত করে উন্নতমানের ক্রীম তৈরী করে। তাছাড়া অনেক মানুষ শাঁখার পাউডার কিনে নিজেরাই মুখে ব্যবহার করছে। এ পাউডার মুখের বর্ন, মেসতা, কালো দাগ দূর করাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয়।
বর্তমানে দেশে উর্ধ্বগতির বাজারে শাঁখা তৈরীর কাঁচামাল শঙ্করের (শামুকের) দাম বেড়ে যাওয়াতে লাভ কম হচ্ছে বলে শাঁখা শিল্পীরা জানান। একজন শাঁখা তৈরীর কারিগর প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ জোড়া শাঁখা তৈরী করতে পারে। এতে তার সমস্ত খরচ বাদে ২শ’ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা লাভ হয়ে থাকে। জানা গেছে, শাঁখা শিল্পের সাথে জড়িতদের অধিকাংশই ভূমিহীন। বসতভিটা ছাড়া তাদের অনেকেরই কিছুই নেই। তারা গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশাসহ বিভিন্ন এনজিও‘র ঋণে র্জজরিত। ব্যাংক ঋণ তাদের ভাগ্যে জোটে না।
শাঁখা তৈরীর কাজে ব্যস্ত জামনগর শাঁখরী পাড়ার যাদব সেনের স্ত্রী বিটু রানী সেন জানান, আমি প্রতিদিন ৪-৫ জোড়া শাঁখা তৈরী করতে পারি। এতে আমার ২শ’ টাকা আয় হয়। আমার স্বামী এ কাজ করে, আমি তাকে সাহায্য করি। উভয় মিলে প্রতিদিন ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা গড়ে আমাদের আয় হয়।
শেখর চন্দ্র সেন জানান, শাঁখা তৈরী করে আমাদের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। পরিবারের ছোট বড় সবাই মিলে আমরা শাঁখা তৈরী করে থাকি। বর্তমানে শাঁখার কাঁচামাল শঙ্করের (শামুক), জিংক অক্সাইড ও এমাফোক্স আটার দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে লাভ কম হচ্ছে। আগের চেয়ে এখন পুঁজিও বেশি লাগে। আমি এক লাখ টাকা মুলধণ নিয়ে প্রথমে এ ব্যবসা শুরু করেছিলাম। তখন শঙ্করের দাম কম ছিল। কিন্তু এখন এর দাম অনেক বেশি। প্রায় ১২ মাসই আমরা শাঁখা তৈরী করে থাকি। তবে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে শাঁখার ভরা মৌসুম বলা হয়। কারন এ সময় প্রচুর পরিমানে শঙ্কর পাওয়া যায়। আমাদের স্বল্প সুদে ঋন দিলে এ শিল্পকে আমরা আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম।
শ্রীদেব সেন বলেন, আমাদের আদি পুরুষরা শাঁখা বানাতো, আমরাও সেই পেশাকে ধরে রেখেছি মাত্র। যা রোজগার হয় তাতে আর আমার সংসার চলতে চায় না। আমার বেশী মুলধন নেই। মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এ কাজ করে বেশি লাভবান হওয়া যায় না। তুলশী রানী জানান, পুজির অভাবে আমরা বেশি মাল কিনতে পারিনা। আমাদের এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। সনাতন ধর্মের মেয়েদের বিয়ে হলে শাঁখা পরা বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বর্তমানে জামনগর শাঁখারী পাড়ার শাঁখারী শিল্পীরা শাঁখা তৈরী করে সাফল্য পেলেও প্রয়োজনীয় মুলধনের অভাবে অনেকেই শাঁখা তৈরীর কাজ ছেড়ে দিয়েছে। শাঁখারীরা জানান, সরকারীভাবে স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করলে তারা এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পারবে ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক নাটোর অঞ্চলের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক এ বি সিদ্দিকী বলেছেন, বিষয়টি শুনে তিনি নিজে শাঁখারী পল¬ী পরিদর্শন করেছেন। সেখানকার ৬০জন শাঁখা শিল্পীকে ইতোমধ্যেই ৬ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। সম্ভবনাময় এই শিল্পে ঋণের পরিধি আরো বাড়ানো যেতে পারে।
Ruby