রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১১

বরেন্দ্র অঞ্চলে সরু ও বাসমতি আতব চাল উৎপাদনে বিপর্যঃ হতাশায় কৃষকেরা

বাঘা নিউজ ডটকম, মোঃ আককাস আলী, নওগাঁ ১১ ডিসেম্বর : বাজারে উচ্চ মূল্য আম্ভ্যন্তীরণ ও বিশ্বের বাজারে চাহিদা ও রপ্তানি হওয়ায় বরেন্দ বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অঞ্চলে সরু ও বাসমতি ধান উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহ এবং চাষ বাড়ালেও এবারে কারেন্ট পোকার আক্রমনের কারণে ফলনে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিপর্যয়ের মাত্রা এতোটায় বেড়েছে যে, অনেক কৃষক ক্ষেত থেকে ধান কাটতে মাঠে যেতে না পেরে আগুন দিয়ে পুড়ে দিয়েছে বলে তাদের সাথে আলাপ করে জানাগেছে। খরচ উঠাতে না পেরে ঋণ মহাজনদের চাপে কৃষকেরা হতাশায় পড়েছেন। কৃষি বিভাগ এ বিপর্যয়ের সত্যতা স্বীকার করেছে। 

    ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রতিকুল আবহাওয়া ও বৃষ্টি অপ্রতুল হয় এমনি অঞ্চল বরেন্দ্র অঞ্চল বরেন্দ্র ভূমি। প্রাচীণ পুন্ডু বর্ধনের প্রায় আট হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বরেন্দ্র অঞ্চল নামে পরিচিত। আবহাওয়া, মাটির গঠন ও ভূপ্রকৃতি অনুসারে রাজশাহী বিভাগের ২৫টি উপজেলা জুড়ে বিশ্বস্ত বরেন্দ্র ভূমি।

   বরেন্দ্র ভূমি অত্যন্ত উর্বর প্রকৃতির টেথিস সাগর থেকে উত্থিলিত প্রাচীন পলিমাটি দ্বারা গঠিত বরেন্দ্র ভূমি ধান চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগি। এ উৎপাদিত ধানের বেশীর ভাগই ছিল মোটা ধান। কিন্তু বিভিন্ন উৎসব, পালা পার্বণে সুগন্ধিযুক্ত সরু ও বাসমতি চালের চাহিদা মিটাতে মোটা ধান বা চালের পাশাপাশি ঐসব চালে উৎপাদন প্রচলন ছিল। কিন্তু ৭০ দশকের পর থেকে উচ্চ ফলনশীল ধান চাষাবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটে। আর্থিকভাবে কম লাভবান হওয়ায় সরু চালের উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। উপসী জাতের ধান নিয়ে দেশ ও বিদেশে ব্যাপক গবেষনা হয়েছে এবং আজও চলছে। কিন্তু সরু চাল উৎপাদন বিষয়ে তেমন কোণ গবেষনা হয়নি।

  এ কথা সত্য যে, আভ্যন্তিরীণসহ প্রাচ্য-প্রচ্যাত্যের সব দেশেই সরু চালের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ইউরূপ, আমীরিকা, আফ্রিকা, অষ্ট্রিলিয়া ও মধ্যেপাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে চাকুরি বেশে অথবা বিভিন্ন কারণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বাঙ্গালিরা। তাদের মাধ্যমে সরু ও বাসমতি চাল জায়গা করে নিয়েছে বিদেশী হোটেল ও রেস্তোরায়। ইউরোপিওদের খাবারের পাশাপাশি সেসব দেশে এখন পোলাও বিরানি, পায়েশ, এগফ্রায়েডরাইস ইত্যাদি ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছে। কারণ এ চাল রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মূল উদ্দেশ্য বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের জীবণমান উন্নয়ন করা। এ লক্ষ্যে বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নানাবিদ কার্যক্রমের পাশাপাশি এ সরু চাল উৎপাদন এবং বিপণন হাতে নেয়।

  এদেশে সরু ও বাসমতি ধানের ইতিহাস কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র ও বরেন্দ্র জানায়, বরেন্দ্র বহুমুষি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ১৯৯৫ সালে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নের বিজয়পুর গ্রামের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ ও বিজয়পুর মাঠে বাসমতি ধান চাষ করেন। এ চাষ একেবারেই প্রাথমিক। পরবর্তী বছরে একই উপজেলার রাইগাঁ ইউনিয়নের মজিরউদ্দীন পাঁচবিঘা জমিতে এ বাসমতি ধান চাষ করেন  কিন্তু বিপণন ব্যবস্থা সুষ্ঠ না থাকায় কৃষকেরা পর্যায়ক্রমে আগ্রাহ হারিয়ে ফেলেন। ১৯৯৭-২০০০ সাল পর্যন্ত এ জেলায় আর বাসমতি ধানের চাষ হয়নি।

    ২০০২ সালে এ,পি,ই,এক্্র মহাদেবপুর উপজেলার ৪০জন কৃষককে উদ্বুদ্ধ করেন এবং সরুবাসমতি ধানের বীজ বিতরণ করেন বোরো মওসুমে। এতে প্রায় দুই হাজার মেঃ টন ধান উৎপাদন ও স্থানী বাজারেরই বিক্রয় হয়। এরপর ্তৎকালিন সরকারের ডেপুটিস্পিকারের উপস্থিতিতে মহাদেবপুর উপজেলার ১০৪জন কৃষকের মাঝে পাঁচ থেকে ১০ কেজি হিসাবে বীজ বিতরণ করা হয়। এ বিতরণকৃত বীজ থেকে প্রায় চার হাজার মন ধান উৎপাদন হয়। যা স্থানীয় রাজ রাইস মিলে ভাঙ্গানোর ব্যবস্থা করা হয়। চালের গুণগতমান ভালো না হওয়ায় সরু ধান ও চাল বিক্রয়ে অসুবিধায় পড়েন কৃষকেরা।

   কৃষকেরা স্থানীভাবে ভালোবীজ না পাওয়ায় ২০০৪ সালে এ ধানের চাষ হ্রাস পায়। একই উপজেলার প্রগতিশীল কৃষক ভারত থেকে একশত কেজি সরু বাসমতি ধান এনে বীজ উৎপাদন করেন। পরের বছর ১৪০ মন ধান বীজ নওগাঁ জেলার পতœীতলা ও বদলগাছি, রাজশাহী জেলার তানোর, মেহেরপুর, দিনাজপুর, জয়পুরহাট জেলার কালাই, এবং বগুড়া সদরের কৃষকদের এক হাজার ৩১৫ কেজি এ ধানের বীজ সরবরাহ করা হয়।

  সংশি¬ষ্ঠ জেলা ও উপজেলাগুলো থেকে ৫০০ থেকে ৫১০ টাকা দরে প্রতিমন ধান পার্বতীপুর জেলার হক ব্যাটারী কোম্পানির মালিক ও টাঙ্গাইল জেলার আরিফ ইন্টারপ্রাইজ কৃষকদের নিকট থেকে ক্রয় করেন। এ দেশের সরুবাসমতি চাল পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্থানের সমতুল্য না হওয়ায় বিশ্বের বাজারে প্রবেশ করতে পারেনি তখন। এর কারণ অনুসন্ধানে জানাগেছে উলে¬খিত দেশগুলোর প্রসেসিং ব্যবস্থা আমাদের দেশের  তুলনায় অনেক উন্নত।

 কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সরুচাল উৎপাদন, বিপণন ও এর সম্ভাব্যতা বিষয়ে এসইএমপি কনসালঠ্রান্ট মোঃ শরীফ উদ্দিন জানান, বিশ্বের বাজারে প্রতি বছর ৬০-৬৫ কোটি মেঃ টন চাল উৎপাদন হলেও বিপণন উদ্বৃত্ত মাত্র চার শতাংশের মত। আর আমাদের দেশে শতকরা ৭০ ভাগ জমিতে উৎপাদিত ধানের প্রায় পুরোটাই মধ্যম ও মোটা জাতের। বাঁিক চার থেকে পাঁচ লাখ মেঃটন সরু চাল উৎপাদন হয়। যা চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক কম। এরপর ও আভ্যন্তিরিণ বাজারে বিপণনের সুযোগ রয়েছে। আভ্যন্তরিণ বাজারে এ চালের বিপণন ব্যবস্থা সীমিত হলেও বর্তমান ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। দেশে আগের তুলনায় বড় বড় হোটেল ও চাইনিচ রেস্তোরার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। সে গুলোতে সরু ও সুগন্ধি চালের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। চালের বড় বড় ব্যবসায়ী ও আড়ৎদারগণ নিয়মিত যোগাযোগ ও সরবহাহ করে আসছেন। এতে দেশে এ চালের আভ্যন্তরিণ চাহিদা বাড়ছে।

   সরু লম্বা চালের চাহিদা উন্নত বিশ্বে প্রচুর। ইউরূপ,যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা, জাপানে প্রচুর। দেশগুলোতে লাখ লাখ মেঃ টন। থাইল্যান্ডের সরু লম্বা বাসমতি চালের চাহিদা ইউরূপ ও জাপানের বাজারে, ভারত পাকিস্থানের চালের চাহিদা আরব দেশসমূহে ও  আমিরিকায় একচাটিয়াভাবে বিক্রয় হয়ে থাকে। যার পরিমন প্রায় ১৫লাখ টন। থাইল্যান্ডের প্রায় ৫৬ লাখ টন এবং ভিয়েতনামের প্রায় ৪০ লাখ মেঃ টন উদ্বৃত্ত চাল বিশ্বের বাজারের বিক্রয় হয়ে থাকে। যা দিয়ে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে উৎপাদকদের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন সাধিত হয়। আমাদের দেশের সরু লম্বাদানা চালের চাহিদা বিশ্বের বাজারের প্রচুর রয়েছে।

  ১৯৯৫ সালে মীরপুরের একটি রপ্তানিকারক সংস্থা প্রায় এক হাজার মেঃ টন চাল রপ্তানি ও বাসমতি প্রতিমন চালে মূল্য ছিল চারশ’ ডলার। সেই সাথে ঢাকা ও চট্রগ্রামের কয়েকটি রপ্তানিকারক সংস্থা আরব দেশসমূহে ও বৃটেনে এ চাল রপ্তানি করে আসছিলেন। বর্তমানে আমাদের দেশে সরু লম্বা সুগন্ধি চাল উৎপাদন বাড়ানো গেলে রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব।


   বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে শুধু পতœীতলায় নয় বরেন্দ্র অঞ্চলে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সরু লম্বা ও বাসমতি ধানে কারেন্ট পোকার আক্রমণে উৎপাদনে ধস নেমে এসেছে। নজিপুর পৌর এলাকার হাসিম রেজারা জানান আমার পাঁচ বিঘা এ জাতের ধানে কাঁচি চালানো যাবে না। একই এলাকার আবুল কালাম জানান আমার অর্ধশত বিঘা জমির ধানে প্রায় ৩২ হাজার টাকার কীট নাশক ব্যবহার করেও অবশেষে সরু সুগন্ধি জাতের প্রায় পাঁচ বিঘা জমির ধান রক্ষা করতে পারিনি। পদ্মপুকুর গ্রামের ফয়জুল হক, মোসলেম উদ্দিন, ইসাহাক আলী জানান তারা পাঁচ থেকে সাতবিঘা করে এ ধান চাষ করলেও একই অবস্থা একই অবস্থার শিকার হয়েছেন। এ উপজেলার পার্শবর্তী উপজেলা ধামইরহাট, সাপাহার, পোরশা ও মহাদেবপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় ২০জন কৃষকের সাথে আলোচনা করলে তারা একই ধরনের অভিমত প্রকাশ করে বলেন কৃষি বিভাগের পরামর্শে ধানক্ষেত আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলেছি। যাতে করে আসন্ন বোরো মওসুমে এ কারেন্ট পোকা নিয়ন্ত্র করা সম্ভব হয়।

   এ বিষয়ে পতœীতলা কৃষি অফিসার আকতারুজ্জামান কৃষকদের অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে জানান, এ উপজেলায় মোট ২৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। এরমধ্যে পাঁচ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে সুগন্ধি সরু আতব জাতের ধান চাষ করেছেন কৃষকেরা। তিনি আরো জানান কোন কোন এলাকায় কারেন্ট পোকার আক্রমনে ক্ষতি হয়েছে। কারণ হিসাবে জানান এ সরু জাতের ধানকে লেট ভ্যারাইটি বলা হয়। অন্যান্য জাতের ধান আগে রোপন ও কাটা হয়। তুলনামূলক সরু ও সুগন্ধি জাতের ধান পরে রোপনের কারণে পরে কাটা হয় হেতু কারেন্ট পোকার আক্রমন বেশী দেখা দিয়েছে।    

   এ ব্যাপারে বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নওগাঁ রিজিয়ন-২,পতœীতলা অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী এজাদুল হক জানান উলে¬খিত প্রকল্প এখন চালু রয়েছে। বর্তমানে আরমা কৃষকদের ব্রিধান ৫০,৫১ ও ৫২ জাতসহ নতুন জাতের সরু লম্বাও বাসমতি জাতের ধান চাষে কৃষদের উদ্বুদ্ধ করে আসছি। তিনি আরো জানান বর্তমানে দেশের আভ্যন্তরিণ চাহিদা মেটাতেই হিমসিম খেতে হচ্ছে।
Ruby