রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১২

লালন শাহ্ : জাত-বেজাতে তার জেতের ফাতা

গৌতম কুমার রায় :: মাঘ মাসের মাঘি পূর্নিমার পরে ফাল্গুন মাসে দোল পূর্নিমার সময়ে লালনের স্মরন উ\সবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এবারে ৭ মার্চ এক ঐতিহাসিক পটভূমির আলোকে উৎযাপন হচ্ছে মরমীসাধক লালন শাহের স্মরন উৎসব।  ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত এই কারণে বাঙ্গালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের স্বাধীনতার উদ্দ্যাত্ত আহবানের  সৃষ্টি সুধার এক মাহিন্দ্রক্ষণে বাউল সাধক লালন শাহের স্মরণ উৎসব আয়োজিত হয়েছে। লালন আমাদের যে ঐতিহ্যগত ধারার সুধা, আবার বাঙ্গালি জাতির মহা নায়কও আমাদের অসিত্মত্ব লালন-পালনের সৃষ্টি সুধা। বঙ্গবন্ধু যেমন আজ দেশ-দেশামত্মরের পরিক্রমায় ছড়িয়েছেন অনেক দূর অব্দি। লালনের সৃষ্টিশীলতাও এখন গন্ডি ছাড়িয়েছে বহুদূর। বিস্তৃতি পেয়েছে দূর থেকে অনেক অনেক দূরে। মরমী সাধকের তিরোধান দিবস নতুবা স্মরন উৎসব এলে অনেক বক্তা তাতিয়ে তাতিয়ে লালনকে কখনও হিন্দু আবার কোন কোন বক্তা তাকে মুসলমান হিসেবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করে থাকেন। লালন নিজে জাত বিজাতের পাল­ায় উঠে না বসলেও হাল আমলের বুদ্ধিজীবিরা কেও কেও তাদের বিকৃত জ্ঞানের অসারতা দিয়ে লালনকে হাজির করেন জাতিতত্ত্ব বিভাজন দিয়ে। যিনি তার  জাতিগত পরিচয়ে সামলে নিয়েছেন নিজেকে বা নিজ স্বত্তাকে। তাকে নিয়ে এখন এই কথা বলাটা  সাম্প্রদায়িকতা উদ্দেশ্যগত প্রনোদনা ছাড়া আর কি হতে পারে। জীবন থাকতে যে তার ধর্ম বা জাতের পরিচয় দেন নাই, বরঞ্চ তার সাধু শিষ্যগণ যখন তাকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন তখন তিনি বলতেন :-
‘ সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন কয় জাতের কিরূপ, দেখলাম না এ নজরে।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারী লোকের কি হয় বিধান ?
বামন চিনি পৈতায় প্রমাণ, বামনী চিনি কি ধরে।
জগত বেড়ে জেতের কথা, লোকে গৌরব করে যথাতথা
লালন সে জেতের ফাতা  বিকিয়েছে সাত বাজারে।’
লালনের জন্ম সূত্রতা নিয়ে কথা ও লেখার বুলি ছড়িয়েছে অনেক। কিন্তু কোন রকমে তা  আজো সম্ভব  হয় নাই তার সমাধান করা। যদি বলি অব্যক্ত ও অজানা জন্ম সূত্রতার কারণে লালন আজ আকাশ ছুঁয়েছে। ফিঙে হয়েছে অনেক গবেষকের তথাকথিত গবেষণা। ফলাফল আর যাই হোক সাম্প্রদায়িকতার বিচ্ছুরণ আগেও ছড়িছে এমনকি এখনও তা ছড়িয়ে যাচ্ছে উদ্দ্যেশ ও কৌশলগত কারণে।
সিদ্ধি লাভের জন্য রূপ পরিগ্রহ করে সাধকের সাধনা। জাত বিজাতের বিষন্নতা সাধককে বিচলিত করে। সিদ্ধি লাভের উপায়কে বিঘ্নিত করে। তাই লালন কোন ধর্ম ভিত্তিতে নিজেকে জড়িত করেন নাই। তিনি তাতে কখনও বিশ্বাসী ছিলেন না। সাধনা  যদি সিদ্ধি লাভের উপাদন হয়, তাহলে সাম্প্রদায়িকতা বা কোন গোষ্ঠিগত চেতনায় সামনে এগিয়ে যাবার  উপায় বাত্লে দিতে পারে কি ?  লালন বলেছিলেন  সবাই জাতির উৎপত্তির কথা শুধায়। তিনি বলে গেছেন ভিন্ন গোত্র থেকে ভিন্ন জাতির জন্ম হয়। তিনি আরো বলেছেন আদিকালে মানুষ প্রামত্ম থেকে প্রামেত্ম ঘুরেছে। বিভিন্ন অাঁচার , বিচার তাদেরকে প্রভাবিত করেছে। মানুষ তখন না জানতো কোন ভূগোল বা না জানতো কারো মনের কোন খবর। আবার এই জাতকে নিয়ে লালন বিষ্ময় প্রকাশও করেছেন। তিনি বলেছেন কলির যুগে এই  জাতকে রক্ষা করা দূরহ হবে।
বিশ্বের কথা না বলে যদি ভারতীয় উপমহাদেশের কথা বলি, তবে ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় সেই স্বদেশী আন্দোলনের সময় থেকে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের সূচনা। এই আন্দোলনের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থ থেকেই এই বিরোধ ক্রমেক্রমে ছড়িয়ে পরে। স্বদেশী আন্দোলনের আগেও এই উপমহাদেশে এই দুই জাতির সম্প্রদায়গত সম্পর্ক ছিল মধুর ও সহবাস ছিল  সম্প্রীতির। যে বিরোধকে সত্মমিত করতে মহাত্মা গান্ধি তার জীবনকে উৎসর্গ করে হলেও তা থামাতে অঙ্গিকার করেন। আবার দেখা যায় এই উপমহাদেশে শুধু যে এই দুই জাতের দন্দ হয়েছে তা কিমত্মু নয়। হিন্দুদের সাথে বৌদ্ধদের দন্দ হয়েছে । এতে বিরাট ক্ষতি হয়েছে উভয়ের। সম্প্রদায়গত দন্দ সৃষ্টির মূলে সামষ্টিক তেমন কোন স্বার্থ কাজ না করলেও ব্যক্তিক স্বার্থই বেশি কাজ করেছে। পৃথিবীতে ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে মানুষের কল্যাণের জন্য কিন্তু তার বিকৃতিতে ভয়াবহতা সৃষ্টি করেছে, ধ্বংস সৃষ্টি করেছে। ধর্মকে ব্যাবহার করে তার বিকৃতি উপাস্থপনায় যে অভিশাপের জন্ম দেয় তার লেলিহান দাহ্য জীবন নেয়, রক্তপাত ঘটায়। কালে কালে এ দেশে বহু মানুষ জন্মেছেন সেই দাহিকা শক্তিকে পরাভূত করতে, সমূলে বিনাশ করতে। এদেশের সুফি-সাধুদের বিচরণ সৃষ্টি হয়েছিল। তারা ছড়িয়ে পড়েছিলেন ক্রমে ক্রমে সর্বত্র। ফরিদপুর জেলার বিখ্যাত কাজী বংশের  এক সুসমত্মান কাজী আব্দুল ওদুদ তখনকার সময়ে ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের অসারশূন্য জীবনধারার বিশেষ করে  মাওলানাদের ধর্মনিয়ে অভিশাপিত কর্মের প্রতিবাদ করেছেন। তিনি জাত-ধর্মহীন নাড়ার ফকিরদের এবং তাদের অনুসারিদের পাশে দাড়িয়েছেন।  লালন তার জন্ম নিয়ে যখন কথা বলেননি, তখন তাকে নিয়ে জাত-বিজাতের ধারা সৃষ্টি করাটা কোন মূলক কাজ নয়। কেননা তাকে নিয়ে ধার্মিকতার বিভেদ তৈরী করলে তা হতে পারে তার আদর্শ অনুভূতির প্রবাহ যাত্রায় বাঁধা সৃষ্টির কাজ। যে কারণে তিনি তার মৃত্যুর আগের রাত্রেও গান করেছেন। ভোর ৫টার সময় তিনি তার শিষ্যদেরকে বললেন, তিনি চললেন। তার মৃত্যুর পরে কোন ধর্মীয় রীতিতে তাকে সমাহিত করা হয় নাই। তাকে রাখা হয়েছে আখড়ার একটি ঘরে। যুগ সন্ধিক্ষনের প্রতিটা মূহুর্তে সিদ্ধি সাধনায় আপি­ত করে রাখতে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যমত্ম যিনি নিজেকে ধর্মীয় বেড়াজালে বন্ধন তৈরী করেন নাই, তাকে নিয়ে এখন তাতেই জড়িয়ে নিতে এত  উদ্দ্যাত হওয়ার কারণ আছে কি?  ব্যক্তি লালন ভাবগম্ভিরে একজন হিন্দু হিসেবে ছিলেন উদাস ভাবুক, আবার তিনি ঐ সময়ে মুসলমানের হাতে ভক্ষণ করে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন  জাত-বেজাতের উর্দ্ধে এক সম্পর্কশূন্য মানুষ হিসেবে । এখানেই লালনের জীবন সার্থক। যিনি কিনা সব জাতের সম্পুরক স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন আবার সকলেই তাকে এই মহিমার কারণে গ্রহণও করেছেন। লালন মানুষকে শুধুই মানুষ হিসেবে চিনতে এবং এক মানুষ অন্য মানুষকে সবার উর্ধ্বে রেখে ভাবতে শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন মানুষের গান হবে মানবতার গান। তিনি সে জন্য বলে গেছেন-
‘ শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই-
দেব- দেবতাগণ করে আরাধন
জন্ম নিতে মানবে।’
লালন জাতের বিচারে মানুষ কে মানুষ মেনে সকলে সমান হয়ে চলার কথা বলে গেছেন, তাইতো তিনি বলেছেন-
‘জাত না গেলে পাইনে হরি, কি ছার জাতের গৌরব করি
ছুঁসনে বলিয়ে।
লালন কয়
জাত হাত পেলে, পুড়াতাম আগুন দিয়ে।’
লালন জাতিগত অছিলতের কারণে রসিকতা ব্যাক্ত করে বললেন-
‘জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা
সত্য কথায় কেউ রাজি নয় সব দোষি তা না না না
এই ভবেতে যখন এলে তখন তুমি কি জাত ছিলে
যাবার সময় কি জাত হলে সে কথা তো কেউ বলেনা।
গৌতম কুমার রায়
গবেষক,পরিবেশ ব্যক্তিত্ব ও পদক বিজয়ী প্রাবন্ধিক,কুষ্টিয়া
মোবা: ০১৭১১-১৪৬-১২৯
Ruby