বৃহস্পতিবার, ৫ এপ্রিল, ২০১২

রাণীনগরে মাদুর বুনিয়ে অভাব থেকে বেড়িয়ে এসেছে পল্লী বধুরা

এম.এ.রউফ (রিপন), রাণীনগর (নওগাঁ) প্রতিনিধি :: “যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তার ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্ তার ভাগ্যের পরিবর্তন করেন না”। দুটো কর্মীর হাত মানুষকে জীবন যুদ্ধে সফলতা এনে দেয়। দেয় অর্থ ও পতিপত্তি। নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলার খট্টেশ্বর গ্রামের ভুমিহীন দরিদ্র অসহায় দিন মজুরের স্ত্রী বিউটি বেগম (৩০) মাদুর বুনিয়ে এখন লাখপতি। কর্মীর দুটো হাতকে কাজে লাগিয়ে হয়েছেন স্বাবলম্বী। দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটনকে জয় করে ফিরিয়ে এনেছেন সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন। সংসার সুখের হয় রমণীর গুনেÑ কথাটির যথার্থতা মনে করিয়ে দেয় এই পল্লী বধু বিউটি বেগম।

প্রায় ১৮ বছর আগে রাণীগর উপজেলার খট্টেশ্বর গ্রামের সরদার পাড়ার ভুমিহীন দরিদ্র দিন মজুর মোয়াজ্জেম হোসেন সরদারের সাথে বিয়ে হয় বিউটি বেগমের। তখন বয়স ১০/১২ বছর হবে। বিয়ের পর থেকেই পেটের দায়ে স্বল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মানুষের মাদুর বুনানোর কাজ শুরু করেন। দিনে ৩ থেকে ৪টি ছোট-বড় সাইজের মাদুর বুনাতেন। মাদুর প্রতি ৩ টাকা করে মজুরী পেতেন। স্বামী ভ্যান চালানো পাশাপাশি মানুষের বাড়ীতে দিন মজুরের কাজ করতেন। স্বামী-স্ত্রীর স্বল্প আয়ের টাকা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে কোন রকমে চলতো তাদের সংসার। অভাব আর অনটনই ছিল তাদের নিত্য সঙ্গী। বাস করতেন ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘরে।

এভাবেই ৮-১০ বছর চলে যায়। এরমধ্যে ১টি মেয়ে ও ১টি ছেলের মা হন। অভাব-অনটনের মধ্যেও অল্প অল্প করে কিছু টাকা জমা করেন ভবিষ্যতের জন্য। মাত্র ৫০০ টাকা নিয়ে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজ বাড়ীতে মাদুর বুনানো শুরু করেন বিউটি বেগম। মাদুর বুনিয়ে স্বামীকে দিয়ে হাটে বিক্রি করাতেন। মাদুর বিক্রির লাভের টাকা থেকে সংসারে কিছু খরচ করতো আর কিছু টাকা জমা করতেন। মাদুর বুনিয়ে সংসারের অভাব-অনটন দূর হয়। এভাবে জমানো টাকা দিয়ে ৪/৫ বছর আগে ৪ বিঘা জমি বন্ধক নিয়েছিল। জমির ধানের টাকা আর মাদুর বিক্রির টাকা জমিয়ে দুই দেবরের আড়াই শতক বাড়ী অংশ কিনে নেন। প্রায় ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে সাড়ে ৩ শতক জায়গার উপর ৪ রুম বিশিষ্ট পাকা বাড়ী নির্মাণ করেন। টিউবওয়েল বসান, ল্যাট্রিন ও রান্নাঘর করেন। দুই বছর আগে মেয়ে তারা (১৫)কে ২ লাখ টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তাদের ২ লাখ টাকা দিয়ে দুই বিঘা জমি বন্ধক নেওয়া আছে। ছেলে ওমর ফারুক রাণীনগর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়ে।

বিউটি বেগম করতোয়াকে জানায়, দু’জন ছাড়া মাদুর বুনানো যায় না। স্বামী, ছেলে-মেয়েদের সহযোগীতায় তিনি মাদুর বুনিয়ে থাকেন। স্বামী সকাল ৭টা পর্যন্ত তাকে মাদুর বুনাতে সাহায্য করেন। সকাল ৭টায় কাজে চলে যায়। কাজ থেকে ফিরে আবার সন্ধ্যা থেকে রাত ৮-৯টা পর্যন্ত মাদুর বুনাতে সাহায্য করে। বাঁকি সময়টা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে মাদুর বুনাতেন। মেয়ের বিয়ের পর ছেলে সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত তাকে মাদুর বুনাতে সাহায্য করে। স্কুল থেকে ফিরে বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছেলে মাদুর বুনাতে সাহায্য করে। দিনে ৮/১০টি মাদুর বুনান। প্রতি হাটে মাদুর বিক্রি করে ৪ থেকে ৫ শত টাকা লাভ হয়। সপ্তাহে ২ দিন হাটবার। নিজে মাদুর বুনানো শুরু করার এক বছর পর একটি এনজিও থেকে ৩ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পুঁজি বাড়ানো হয়। মাদুর বিক্রি করে প্রতি সপ্তাহে কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করে আবারো ৫ হাজার টাকা করে ঋণ নেয়। বর্তমানে ৩টি এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেওয়া আছে। মাদুর বুনানো পাতির দামের উপর কম-বেশী লাভ নির্ভর করে। এছাড়াও বন পাতি দিয়ে মাদুর বুনালে বেশী লাভ হয়। মাদুর বুনিয়ে অনেক পল্লী বধুরা সংসারে খরচ বহন করছে। গরীব মানুষদের ভাগ্যে সরকারী কোন সুযোগ-সুবিধা ও অনুদান জোটেনা। আজ পর্যন্ত তাদের দিকে মেম্বার, চেয়ারম্যানসহ সরকারী লোক কেউই তাদের কোন খোঁজ-খবর নেয়নি। ছেলে ওমর ফারুককে সরকারী চাকুরীর আশায় লেখা-পড়া করাচ্ছেন।

খট্টেশ্বর গ্রামের আরেক পল্লী বধু মঞ্জুয়ারা (৩৮) জানান, তিনিও দু’টি এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। মাদুর বুনিয়ে প্রতি হাটে ২৫ থেকে ৩০টি মাদুর বিক্রি করেন। প্রতি হাটে ৫ থেকে ৭ শত টাকা লাভ হয়। এই লাভের টাকা দিয়ে প্রতি সপ্তাহে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন এবং বাঁকি টাকা দিয়ে সংসার খরচ চালান। মাদুর বুনিয়ে সংসার খরচ ভালভাবেই চালানো যায়। তাই অনেকেই মাদুর বুনায়।

এ গ্রামের বাসিন্দা জবেদ আলী (৫৮) জানায়, তার বাড়ীতে তিনটি হাত মেশীনে মাদুর বুনানো হয়। প্রতিদিন সোয়া ২ হাত, আড়াই হাত, ৩ হাত বিভিন্ন সাইজের মাদুর বুনানো হয়। এনজিও গুলো থেকে ঋণ নিয়েই তারা মাদুর বুনান। সরকারী ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক ঝামেলা তাই তারা এনজিও থেকেই ঋণ নেয়। চৈত্র থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত পাতির দাম কম থাকে। পাতির কোন সংকট থকে না। লাভও বেশী হয়। এখন পাতির দাম বেশী এবং পাতি ঠিক মতো পাওয়া যায় না। লাভও কম। কারণ মাদুরের দাম একই থাকে। সাইজ অনুসারে ৩৫ টাকা থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত একটি মাদুর দাম পাওয়া যায়। রাণীনগরের প্রতিটি গ্রামেই মহিলারা মাদুর বনানোর কাজে জড়িত রয়েছে। এই মাদুর বিক্রি করেই তারা তাদের সংসার খরচ চালাচ্ছেন। #
Ruby