রবিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১২

বিদ্যুৎ সঙ্কটে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের শিল্পখাত

বিদ্যুৎ সঙ্কটে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের শিল্পখাত। দীর্ঘ লোডশেডিং আর রাতে শিল্পে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে সরকারের অলিখিত নির্দেশনায় বিপাকে পড়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। ছোটবড় শিল্পে নেমে এসেছে স্থবিরতা। প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ না পাওয়ায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। আবার কোন কোন কারখানার জনবল কমানোর চিন্তা করা হচ্ছে।
রপ্তানিমুখী শিল্প উদ্যোক্তা রপ্তানি আদেশ রক্ষা করতে পারছেন না। এদিকে নিয়মিত লোডশেডিংয়ের সঙ্গে রাতে ১২ ঘণ্টা শিল্প এলাকায় কারখানা বন্ধ রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে যে অনুরোধ করা হয়েছে এ নিয়ে শিল্পখাতে অসন্তোষ ও বিভ্রান্তি রয়েছে। সরকার এই সময়ে শিল্পজোনে কারখানা বন্ধে উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করা হলেও তা সরকারি সিদ্ধান্ত বলে অনেক এলাকায় এই সময়ে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হচ্ছে। আবার কোথাও এই সময়ে কারখানা চালু রাখার কারণে সংযোগ বন্ধ করে দেয়ার ভয় দেখানো হচ্ছে শিল্প মালিকদের। রাতে শিল্প কারখানা বন্ধ রাখতে অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আবার কোথাও মাইকিং করে শিল্প বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।

দক্ষিণাঞ্চলে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম
, লোডশেডিংয়ের তীব্রতায় নাকাল খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের শিল্পে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিদ্যুতের সীমাহীন সংকটের কারণে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। লোডশেডিংয়ের কারণে হিমায়িত চিংড়ি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এ শিল্পের বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আছিয়া সি ফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরিকুল ইসলাম জহির জানায়, বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে আমাদেরকে চিঠি দেয়া হয়েছে রাতে সকল মাছ কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রাখতে। আর দিনের বেলা বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। সরকার এ ধরনের দেশের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত নিলে সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী পথে বসবে। বিপর্যয় নেমে আসবে দেশের অন্যতম রপ্তানি খাতে।
খুলনা চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক ও মধুমতি সল্ট ইন্ডাস্ট্রির স্বত্বাধিকারী ওমর ফারুক মিঠু জানান, বিদ্যুতের অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে গত দু’দিন ধরে কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। আর বারবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে শ্রমিকরা কাজ করতে চায় না। ইতিমধ্যে কারখানা থেকে অনেক শ্রমিক চলে গেছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে নিজের টিকে থাকার স্বার্থে মিলটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবো। এর ফলে ৭/৮শ’ শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়বে। তিনি এ অবস্থার অবসানের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় তারা পর্যায়ক্রমে সব স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। এ কারণে কিছু লোডশেডিং হয়।

মাইকিং করে কারখানা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে
বিদ্যুৎ লোডশেডিং কমাতে  সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সরকারের সিদ্ধান্ত নরসিংদীতে মিলকারখানার মালিকরা মানতে রাজি নয়। এমনিতেও প্রতিদিন গড়ে ৭-৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। এ সিদ্ধান্ত মানা হলে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। নরসিংদী শহরের  উত্তর সাটিরপাড়া নাসির ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং ফিনিশিং ইন্ডাস্ট্রিজ প্রা. লি.-এর পরিচালক জাকির হোসাইন বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত কোন অবস্থায়ই মানা যাবে না। বিদ্যুতের জন্য যদি ১২ ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয় তা হলে এ প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এমনিতেই প্রতিদিন ৯ থেকে ১০ বার বিদ্যুৎ যায় অর্থাৎ গড়ে ৭-৮ ঘণ্টা  বিদ্যুৎ থাকে না। এর পর ১২ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হবে। বিদ্যুৎ অফিস থেকে মাইকিং করে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত শিল্প বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। এ ঘোষণার পর গত ২৮শে মার্চ মাধবদীতে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা আন্দোলনে গেলে জেলা প্রশাসক ওবায়দুল আজম সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
রাঙ্গামাটি এলাকার সুমন টেক্সটাইলের শ্রমিক অলি জানান, সপ্তাহে কাজ করে আগে ২ হাজার টাকা পাওয়া যেতো আর বিদ্যুতের লোডশেডিং-এর কারণে কোন সপ্তাহে ১২শ’ বা ১৫শ’ টাকা পাওয়া যায়। আর যদি সরকারের সিদ্ধান্ত মানা হয় তা হলে ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা পাওয়া যাবে।
উত্তর সাটিরপাড়া এলাকার সরকার টেক্সটাইলের মালিক বাবুল সরকার বলেন, সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত সরকারের সিদ্ধান্ত মতে শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কথা থাকলেও কোন চিঠি পাইনি বলে তিনি জানান। যদি সবাই মিলকারখানা বন্ধ রাখে তা হলে আমিও রাখবো। এখন দিনে সকালে ১ ঘণ্টা, দুপুরে দেড় ঘণ্টা, বিকালে ১ ঘণ্টা রাতে ৩-৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। আবার রাতে ১২ ঘণ্টা টেক্সটাইল মিল বন্ধ রাখতে বললে তা হবে অযৌক্তিক। নরসিংদী পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মো. রবিউল হোসেন বলেন, লোডশেডিং কমাতে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় সরকারের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরই গত ১৫ দিন আগে নরসিংদী সর্বত্র মাইকিং করে বলে দেয়া হয়েছে। তবে কোন চিঠি দেয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, মাইকিং করার পর থেকে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে। এরপরও যদি কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান সরকারের এ আদেশ না মানে তা হলে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে বলে তিনি জানান।

সাভারে কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত
সাভারে লোডশেডিংয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে শিল্প কারখানার। ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন মুখে পড়েছেন শিল্প কারখানা মালিকরা। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৪-১৫ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকছে না ওই এলাকায়। হা-মীম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) মোহাম্মদ আলী মণ্ডল জানান, বিদ্যুৎ বিভ্রান্তির কারণে আমাদের কারখানায় ২৪ ঘণ্টাই জেনারেটর চালানো হচ্ছে।  হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভির মাহমুদ জানান, লোডশেডিংয়ের কারণে সময়মতো শিপমেন্ট দিতে পারছি না। দ্বিগুণ খরচে ডিজেল জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালু রাখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১’র সাভার জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) ইমরুল হাসান ভূঁইয়া জানান, বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। সাভারে প্রায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ৬০ মেগাওয়াটেরও কম। তিনি আরও বলেন, গ্যাস সঙ্কটের কারণে আশুলিয়া পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাহত হওয়ায় লোডশেডিংয়ের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মানিকগঞ্জে বেশির ভাগ সময় কারখানা বন্ধ থাকে
নজিরবিহীন লোডশেডিংয়ের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে মানিকগঞ্জের বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র মাপের প্রায় ৩৫০ শিল্প কারখানা। এসব মিল কারখানায়  উৎপাদন ক্রমেই ব্যাহত হচ্ছে।   মানিকগঞ্জ জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬৫ মেগাওয়াট। কিন্তু তার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২০ থেকে ২৫ মেগাওয়াট। এ জেলায় বসুন্ধরা স্টিল, মুন্নু ফেব্রিক্স,গামেন্টর্স, আকিজ পার্টিকেল অ্যান্ড হার্ডবোর্ড, তারাসিমা অ্যাপারেলের মতো বড় ও মাঝারি-ক্ষুদ্র শিল্প কারখানায় চার ভাগের এক ভাগ সময় বিদ্যুৎ পাওয়া না।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ঘেষা মানিকগঞ্জের জাগীর এলাকায় প্রতিষ্ঠিত বসুন্ধরা স্টিল মিলস কমপ্লেক্সের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মো. এনামুল হক জানান, বসুন্ধরা স্টিল মিলের বিদ্যুৎ চাহিদার চার ভাগের এক ভাগও পাওয়া যাচ্ছে না। কখন বিদ্যুৎ যায় আবার কখন আসে তার হিসাব নেই। তিনি বলেন, স্টিল মোল্ডিংয়ের গলানোর সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে মোল্ডিং স্টিল ঠাণ্ডা হয়ে যায়। পরে আবারও মোল্ডিং করতে হয়। এতে খরচ ডাবল হয়। এ কারণে উৎপাদন কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ার উপক্রম দেখা দিয়েছে। বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাস সংকোচও তীব্র আকার ধারণ করেছে। তরাসিমা অ্যাপারেল লিমিটেড-এর মেইনটেন্যান্স ম্যানেজার আজগর আলী জানান, আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ২ মেগাওয়াট। কিন্তু পাচ্ছি অর্ধেকেরও অনেক কম। তারাসিমা অ্যাপারেল সম্পূর্ণ বিদেশীভাবে পণ্য রপ্তানি করে। ফলে সময়মতো পোশাক তৈরি করতে বাধ্য হয়ে জেনারেটর ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে প্রায় চার গুণ খরচ বেশি পড়ছে বলে তিনি জানান। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া  উপজেলার বালিয়াটি এলাকায় শরিফ ইন্ডাস্ট্রিজে কড়াই তৈরি কারখানাটি বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দিয়েছে। কারখানার মালিকদের একজন ফজলুর রহমান জানান, এখানে ২০০ শ্রমিক কাজ করে। কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া গেলে কারখানাটি চালানো সম্ভব। কিন্তু এক মাস ধরে দুই তিন ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ না পাওয়ায় কারখানাটি কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
Ruby