শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে মূলায়ন করা হয়েছে ভাষা সৈনিকদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি....ভাষা সৈনিক খাদেমূল ইসলাম

মোঃ আককাস আলী, নওগাঁ প্রতিনিধি :: বয়স ৮১। বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুজ হলেও মনোবল এখনও তরতাজা। হবেই না বা কেন। তিনি যে একজন সংগ্রামী বীর। মহান ভাষা আন্দোলনের মহা নায়ক। ১৯৫২ থেকে ২০১১ দীর্ঘ ৫৯বছরে স্মৃতির আয়না থেকে তাঁর হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই। তবে আজও যতটুকু স্মৃতি মনে পড়ে তা থেকে তিনি সুখ অনুভব না করে বরং কষ্ট পান। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাষা সৈনিকরা প্রকৃতপক্ষে কোথায়, কিভাবে আছেন, কিভাবেই বা জীবণ যাপন করছেন সেটি ভাবলে এখনও তার বুকে ব্যথা লাগে। তাই শহরের কোলাহলমুক্ত পরিবেশ থেকে দূরে বহৃদূরে নওগাঁ জেলার মফস্বল শহর পতœীতলার নজিপুরে বসেই তিনি মাঝে মাঝে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করেন এবং নিজেকে একজন গর্বিত সৈনিক হিসাবে আতœতৃপ্তি লাভ করেন।  নিভৃতচারী ভাষা সৈনিক খাদেমুল ইসলাম ১৯৩০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী নওগাঁ জেলার পতœীতলা উপজেলার গগণপুর গ্রামে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার বাড়ি পাশ্ববর্তী ধামইরহাট উপজেলার লক্ষণপাড়া গ্রামে।  পিতা খয়বর আলী ছিলেন এলাকার একজন নামকরা ও স্বনামধন্য স্কুল শিক্ষক। বর্তমানে এই নিভৃতচারী ভাষা সৈনিক বাস করছেন পতœীতলা উপজেলার নজিপুর পৌর সদরের চাঁদপুর গ্রামে। আলহাজ্ব খাদেমুল ইসলাম একান্ত আলাপচারিতায় এ প্রতিনিধিকে জানান, ভাষা আন্দোলনে যখন সারাদেশ উত্তাল তখন তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নেতারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে সায় না দিলেও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা  ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল সমাবেশ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং  ১০জন ১০জন করে ভাগ হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১ তারিখে সকালে  মিছিল নিয়ে আমরা রাস্তায় নেমে পড়ি যার ১ম দলেই আমি ছিলাম। মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে প্রধান সড়কে নামার আগেই পুলিশ আমাকেসহ আরো প্রায় ৫০জন ছাত্রকে আটক করে প্রথমে লালবাগ থানায় এবং সন্ধ্যায় জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়। জেলখানায় বসেই আমি পুলিশের গুলিতে প্রিয় সহপাঠি বরকতের  মৃত্যুর খবর পাই। সে সকাল ১০টায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। মশার যন্ত্রণা, মাথায় ইটের বালিশ, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে আমাকে ২৮দিন জেলখানায় কাটাতে হয়। জেলখানায় তিনি সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সাথে একই সেলে ছিলেন বলেও জানান।  পড়াশুনা শেষ করে নিজ এলাকায় ফিরে এসে তিনি পিতার পেশা শিক্ষকতায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৫৩ সালের শেষের দিকে নজিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবণ শুরু করেন। পরবর্তীতে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ ১৯৯০ সালে ধামইরহাট সদর উচ্চ বিদ্যালয় হতে অবসর গ্রহণ করেন।  অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন এলাকার শিক্ষার উন্নয়নে। তিনি বহু দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীকে বিনা পয়সায় পাঠদান করেছেন। তার তৈরী করা বহু ছাত্র-ছাত্রী সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও চাকুরীজিবি। পাঠদানের পাশাপাশি তিনি নিজেকে জড়িত করান বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে। তার একান্ত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে এলাকায় গড়ে উঠেছে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নজিপুর মহিলা কলেজ, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ, আল-হেরা ইসলামী একাডেমী প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জমি দান করেছেন এবং তৈরী করেছেন একটি পাঠাগার ও মসজিদ।  ভাষাসৈনিক খাদেমুল ইসলাম বিরল প্রতিভার অধিকারী হলেও নিজেকে জনসম্মুখে তুলে ধরার কোন চেষ্টাই তিনি করেননি। গৃহমুখী হয়ে জীবণ যাপনেই তিনি বেশী অভ্যস্ত। বর্তমানে তার সময় কাটে পত্রিকা পড়ে, বই পড়ে ও নামাজ পড়ে। তবে গত ২০০৬ সালে তার প্রিয় সহধর্মীণীর আকষ্কিক মৃত্যু তাঁকে বিমর্ষ করে তুলেছে। সহধর্মীণীর স্মৃতি বুকে নিয়েই  বর্তমানে তাঁর নিঃসঙ্গ দিন কেটে যায়। ভাষা সৈনিক খাদেমুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, আর্থিক সংকট কখনও তাকে স্পর্শ করতে পারেনি এটি সত্য। কারণ একমাত্র ছেলে বাংলাদেশর একজন স্বনামধন্য হার্ড স্পেশালিস্ট ও সার্জন ডাঃ কামরুল আহমান, একমাত্র মেয়েকে ভাল জায়গায় বিবাহ দিয়েছেন। নিজ সহায় সম্পদ যা আছে তা দিয়ে সুখে শান্তিতে দিন কেটে যায়। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের চলমান দুরাবস্থা, বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তাকে দারুণভাবে পীড়া দেয়। তাঁর মতে, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙ্গালীর মনে স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত হয়েছে। যার ফল হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ভাবে সম্মান প্রদর্শন করা হলেও ভাষা সৈনিকদের জাতি সেভাবে মূল্যায়ন করেনি। এটি ভাবতে তাঁর বড় কষ্ট হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাষা সৈনিকদের খুঁজে বের করে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদর্শনের জন্য তিনি সরকারের প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন।
Ruby