শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব “চারঘাটে ঐতিহ্যবাহী খয়ের শিল্প বিলুপ্তির পথে”

মোঃ মেহেদী হাসান, চারঘাট (রাজশাহী) থেকে :: রাজশাহীর চারঘাটে ঐতিহ্যবাহী খয়ের শিল্প বর্তমানে ধ্বংসের মুখে।  সরকারী পৃষ্টপোষকতার অভাবে এ শিল্পের সংঙ্গে জড়িত পরিবারগুলো অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এক সময় এ পেশায় সাথে জড়িত ছিল প্রায় ২ লাখ মানুষ। এখন তা ২ হাজারের কোটায় নেমে এসেছে। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে এক সময় ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটি বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে। প্রাচীন উৎপাদন পদ্ধতি, আমদানিকৃত খয়েরের সাথে দেশী খয়েরের অসম প্রতিযোগীতা দৌরাত্ম্যসহ নানাবিধ কারনে শিল্পটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকারি পৃষ্টপোষকতার প্রয়োজন। ১৯৫২ সালে স্থানীয় ব্যক্তি মুন্সি নূরুল হক ও তাহের উদ্দিন প্রামানিকের উদ্যোগে চারঘাটে খয়ের শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকে তদানিন্তন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত বিহারিদেও মাধ্যমে এই শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসার ঘটে। সে সময় স্থাণীয় ব্যাক্তিরা ব্যাপক ভাবে এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে পড়েন। অথচ খয়েরের মোট চাহিদার শতকরা ৯০ ভাগই চারঘাট থেকে পূরুন করা হয়। ভোজন প্রিয় বাঙ্গালীর খাবারের সীমাবদ্ধতা নেই। দৈনন্দিন তিন বেলা খাবারের পওে অনেকেই অভ্যাসগত কারনে কিংবা শখের বসে পান খেয়ে থাকেন। আর এ পানকে সুস্বাদু করতে নানান ধরনের মশলার সংমিশ্র করা হয়। এর মধ্যে খয়ের হল অন্যতম উপাদান। খয়ের কেবল ঠোঁট লাল করার কাজই ব্যবহার হয় না এর ব্যবহার বহুবিদ। ওষুধ, জর্দ্দার রং, কেমিক্যাল প্রভৃতি তৈরী করতেও খয়ের ব্যবহার করা হয়। খয়েরের বৈজ্ঞানিক নাম ’ একাচিয়া ক্যাটেচু’। খয়ের শিল্পের কাচাঁমাল খয়ের গাছ। চারঘাট ছাড়াও দিনাজপুর, ঘোড়াঘাট, রংপুরের ভুরুঙ্গামারী, ঈশ্বরদী, পাবনা ও কুষ্টিয়া  অঞ্চলে খয়ের গাছ উৎপন্ন হয়। খয়ের কি ভাবে তৈরী হয় ? খয়েরের ইতিহাসই বা কী ? এ নিয়েও রয়েছে নানান কৌতুহল।
জানা গেছে, ১৯৪৭ সালের গোড়ার দিকে ভারত থেকে খয়ের গাছের চারা মিয়ে এসে চারঘাটের বিভিন্ন অঞ্চলে লাগান হত। খয়ের গাছ দেখতে কিছুটা বাবলা গাছের মত। ১৫ বছর বয়সি গাছ খয়ের উৎপাদনের জন্য উপযোগী হয়। খয়ের গাছের উপরের সাদা অংশ তুলে ফেলে ভেতরের লাল বর্ণেও শাস কুচি কুচি কওে কেটে তা মাটির পাতিলে বিশেষ নিয়মে তাপ দিতে হয়, সেই তাপে লাল বর্ণের শাস থেকে লাল রস বের হয়। এই রস গাঢ হলে তা পাতিলে ঢেলে রাখা হয় । এই অবস্থাকে বলা হয় লালি খয়ের। লালি খয়ের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়  শক্ত  খাটি খয়ের এ রুপ নেয়। জানা গেছে, কেবল রাজশাহী জেলার চারঘাট থানাতেই তৈরী হত। বৃহত্তর রাজশাহী জেলার পুঠিয়া, লালপুর,  নাটোর সহ বিভিন্ন অঞ্চলে এই খয়ের গাছ তৈরী হত সেখান থেকে খয়ের চাষীরা গরুর গাড়ি অথবা অন্য যানবাহনে করে চারঘাটে  এসে বিক্রয় করত। এক গরুর গাড়ি খয়ের কাঠের দাম ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা  দরে বিক্রি হত। লালি খয়ের বিক্রয় হয় ২৪ শ থেকে ৬ হাজার টাকা মন দরে। জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী এই লাগানোর সরকারী কোন উদ্যোগ নেই। যে পরিমান গাছ রয়েছে সেগুলো পর্যায়ক্রমে কেটে ফেলায় খয়ের বাগান দিনে দিনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নতুন ভাবে খয়ের গাছের উৎপাদন শুরু করা না হলে এক সময় ধ্বংসের মুখে পড়বে এই খয়ের শিল্প।
ষাট, সত্তর ও আশির দশক ছিল খয়ের শিল্পের জন্য সুবর্ণ সময়। ওই সময়ে চারঘাটের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ খয়ের শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তুু নব্বই দশকের প্রথম দিকে নানাবিধ কারণে এই শিল্প ধ্বস নামে। খয়ের শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য চারঘাটের ব্যবসায়ীরা বহুমুখী সমবায় সমিতি গঠন করে। তারপরও খয়ের ব্যবসায় টিকে থাকা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। চারঘাটের খয়ের শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা জানান, খয়ের শিল্পকে টিকাতে হলে সরকারী পৃষ্টপোষকতা প্রয়োজন। প্রাচীন উৎপাদন পদ্ধতি, আমদানিকৃত বিদেশী খয়েরের সাথে অসম প্রতিযোগীতা বন্ধ করতে হবে। প্রচুর পরিমানে কাচাঁমালের  ব্যবস্তা করতে হবে, ইজারাদার ও মধ্যবর্তী দালালদেও দৌরাত্ম কমানো, নির্দিষ্ট সময়ে খয়ের বিক্রি বা বাজারজাত করনের অসুবিধা। প্রতি বছর খয়েরের যে উৎপাদন হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প। প্রতি বছর তা ধাপে ধাপে কমছে। এ খয়ের শুধু দেশেই ব্যবহার হয়না বিভিন্ন বিদেশেও পাঠানো হয়। এই শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব হলে এর সংঙ্গে জড়িতরা যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে,তেমনী বেকার জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে চারঘাট খয়ের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক সহ খয়ের ব্যবসায়ী মোস্তফা , আব্বাস আলী শেখ ও এনামুল হক এ ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেন।

Ruby